‘তালাকের জন্য সব সময়ই ভারতীয় মুসলিম নারীদের দায়ী করা হয়। আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। তালাক দেওয়ার পর আমি আমার স্বামীর কাছে ফেরত যেতে চাইনি। তার মানে এই নয়, আমি এই ধর্মীয় নিয়মের বিরুদ্ধে লড়াই করব না। এই লড়াই ন্যায়বিচারের জন্য।’
কথাগুলো বলছিলেন ভারতের রাজস্থান রাজ্যের রায়পুরের আফরিন রহমান। যে পাঁচজন নারী মুসলিমদের বিবাহবিচ্ছেদে ‘তিন তালাক’ প্রথা অবৈধ ঘোষণার দাবিতে লড়াই করছিলেন, তিনি তাঁদেরই একজন। আজ মঙ্গলবার তাঁরা সফলতার মুখ দেখেছেন। ভারতের উচ্চ আদালত তিন তালাক অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন।
অন্য চার নারী হলেন উত্তরাখণ্ড রাজ্যের কাশিপুরের সায়েরা বানু, পশ্চিমবঙ্গের ইসরাত জাহান, উত্তর প্রদেশের সাহারানপুরের আতিয়া সাবরি ও একই প্রদেশের রামপুরের গুলশান পারভীন।
লড়াইটা মোটেও সহজ ছিল না মন্তব্য করে সায়েরা বানু বলেন, ‘তাৎক্ষণিকভাবে তিন তালাকের বিধান নারীর জীবনকে হঠাৎ করে একেবারে বদলে দিত। এর ফলে ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যায়।’
তালাকের এই বিধান কীভাবে জীবনকে একেবারে বদলে দেয় তার বর্ণনা দেন ইসরাত জাহান। তিনি জানান, তাঁর স্বামী দুবাই থেকে হঠাৎ ফোন করে তাদের ১৫ বছরের বিবাহিত জীবনের সমাপ্তি ঘটায় তিনবার তালাক বলে। তাঁর স্বামী জানায়, তিনি দ্রুতই অন্য নারীকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন।
উত্তর প্রদেশের সাহারানপুরের আতিয়া সাবরি জানান, একদিন তাঁর স্বামীর তিন তালাক লেখা একটি চিঠি তাঁর ভাইয়ের অফিসে আসে। এতেই তাঁর বিবাহিত জীবনের সমাপ্তি ঘটে। কিন্তু ইসলামী শরিয়াহ অনুযায়ী বিয়ে হয় দুই পক্ষের সম্মতিতে।
একপক্ষের সিদ্ধান্তে কীভাবে তালাক (ডিভোর্স) হয়, সে প্রশ্ন তুলে আতিয়া সাবরি বলেন, ‘এ জন্য আমি এই তালাক মেনে নিতে পারিনি।’
স্বামী রড দিয়ে পেটালে উত্তর প্রদেশের রামপুরের গুলশান পারভীন পুলিশের শরণাপন্ন হন। এতেই স্বামী রেগে গিয়ে তাঁকে তালাক দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে পারভীন বিবাহের অধিকার পেতে উচ্চ আদালতে আপিল করেন।
এ বিষয়ে পারভীনের ভাই রইস বলেন, ‘শুধু ছেলের জন্য পারভীন তাঁর স্বামীর কাছে ফিরে যেতে চেয়েছিল, যাতে তাদের সন্তান পরিবারের মধ্যে বেড়ে উঠতে পারে। তা ছাড়া আমি কিংবা আমাদের পরিবারই পারভীনকে কতদিন সাপোর্ট দিতে পারতাম?’
তিন তালাক—ধর্মে কি আছে
ইসলাম মতে বিবাহ হলো সামাজিক চুক্তি বা বন্ধন। আবার এই সামাজিক বন্ধন যদি সুখকর সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয় তবে ইসলাম তালাক বা বিচ্ছেদকে অনুমোদন করে। কিন্তু কোরানে বলা আছে ইসলামে তালাক বৈধ হলেও আল্লাহ তালাককে সবচেয়ে অপ্রিয় (ঘৃণ্য) বিষয় বলে গণ্য করেন। অর্থাৎ ইসলাম মতে কোনো পার্থিব লাভের ভিত্তিতে তালাক বা বিচ্ছেদ ঘটানো উচিত নয়। আল্লাহ তা পছন্দ করেন না। বিরোধ ও কলহের অবিরাম প্রবাহ চলতে থাকলেই ইসলাম মতে তালাক বা বিচ্ছেদ কাম্য।
এখন দেখা যাক কোরানে কী বলেছে
১। সুরা: আন্নিসা, আয়াত ৩৫ — ‘‘আর যদি তোমরা উভয়ের (স্বামী ও স্ত্রী) মধ্যে বিরোধের ভয় কর, তাহলে একজন বিচারক নিযুক্ত কর — পুরুষের পক্ষ হতে ও স্ত্রীর পক্ষ হতে। যদি উভয়েই সংশোধন চাও, তাহলে আল্লাহ তাদের মধ্যে মিলন এনে দেবেন।’’
২) সুরা: আন্নিসা, আয়াত ১২৮ — ‘‘যদি কোনো নারী তার স্বামীর কাছ থেকে খারাপ ব্যবহারের ভয় করে কিংবা বিচ্ছেদের, তাহলে তারা যদি নিজেদের মধ্যে শান্তির কোনো চুক্তি সম্পাদন করে তবে তাতে তাদের কোনো পাপ হবে না। শান্তিই উত্তম।’’
৩) সুরা: আল্ বকরাহ, আয়াত ২২৭ — ‘‘আর যদি তারা তালাক দিতে মনস্থ করে, তাহলে আল্লাহ নিশ্চয় জানেন ও শোনেন।’’
৪) সুরা: আল্ বকরাহ, আয়াত ২২৮ — ‘‘তালাক প্রাপ্তা নারীরা তিন ঋতুকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করবে (তারা গর্ভবতী আছে কিনা তা জানার জন্য)…ইতিমধ্যে তারা যদি পুনঃমিলিত হতে চায়, তাহলে তাদের স্বামীদের অধিকার আছে তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার। আর তাদেরও (দ্বিতীয়বার তালাকপ্রাপ্ত নারীদের) একই অধিকার আছে তাদের পক্ষে…ন্যায়সঙ্গতভাবে।’’
যুক্তি কী বলে
মৌলবাদীদের অনেকে বলছেন যে তালাক আছে বলেই মুসলিম সমাজে বধূহত্যা কম। তাদের মতে তিন তালাক প্রথা বন্ধ করার মধ্যে দিয়ে মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের অধিকারগুলিকে নস্যাৎ করতে চাওয়া হয়েছে। কিন্তু তা বলে তিন তালাক-এর মতো একটি অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী ব্যবস্থাকে মান্যতা কেন দেবো? আমরা বিবাহ বিচ্ছেদের বিরোধী নই। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিভেদ বাড়লে নিশ্চয় পরস্পর সম্মতির ভিত্তিতে বিচ্ছেদ চাইতে পারে। কিন্তু একতরফা তিনবার তালাক বলে কেন স্ত্রীকে তাড়িয়ে দেবার অধিকার থাকবে?
যদিও বাংলাদেশে কেউ যদি তিন তালাকের বিরুদ্ধে আইনগত সুরক্ষা চায় তাহলে তাকে সেটি দেয়া হয়। তবে এর বাস্তবপ্রয়োগ খুবই সীমিত। রাগের বশে দেওয়া এমন ‘তিন তালাকি’ বিষে অনেক দম্পতির জীবনই দুর্বিষহ হয়ে পরে। কারণ, রাগ পরে যাওয়ার পর তারা বুঝতে পারে যে তারা আসলে বিচ্ছেদ চায় না। কিন্তু মৌখিক তিন তালাকেই এমন দম্পতির ‘বিয়ে বিচ্ছেদ হয়ে গেছে’ বিশ্বাসে অনেক এলাকায় তাদের আবার বিয়ে করার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন মুরব্বীরা, সমাজপতিরা। এজন্য মেয়েটিকে হিল্লা বিয়ের ঝামেলায় পড়তে হয়। তালাক দেওয়া স্ত্রীকে নিয়ে ফের সংসার করা যায় না। তবে তাকে আবার বিয়ে করতে হলে আগে তার অন্য লোকের সঙ্গে বিয়ে হতে হবে। এরপর ওই লোক তাকে তালাক দেওয়ার পর ফের সাবেক স্বামী বিয়ে করতে পারবে তাকে।
এক্ষেত্রে হিল্লা বিয়ের পর নয়া স্বামী-স্ত্রীর উভয়ের যৌনতারও বাধ্যবাধকতা থাকে। ফলে বিষয়টি জটিলতায় পর্যবসিত হয়। হিল্লা বিয়ে নিয়ে পরে অনেক বিচার-সালিশ, মারামারি, খুনোখুনি, মামলা-মোকদ্দমার ঘটনা আছে।এটার জন্য দায়ী তালাক সম্পর্কিত ইসলামী আইন নিয়ে ভুল ধারণা।