টানা ১০৮ ঘণ্টা আইসিইউতে লড়াই করে অবশেষে মৃত্যু বরণ করর নৃশংস নিপীড়নের শিকার শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফি।
ঢামেক হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগেরতথ্যনুযায়ী, নুসরাতের শরীরের ৮৫ শতাংশ মেজর বার্ন। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ গভীর পোড়া। এমনকি তার শ্বাসতন্ত্রও পোড়া ছিল।চিন্তা করে দেখলাম , ভালই হয়েছে নুসরাত মরেছে। কি হবে এই মৃত্যু উপত্যকায় বেঁচে থেকে? কি হবে নিপীড়নের বিপক্ষে কথা বলে? আর কেউই বা শুনবে নুসরাতদের কথা।যে সমাজের শত শত জনসাধারধ যৌন নিপীড়নকারীর পক্ষে মিছিল করে, সেই সমাজে না থাকাই ভাল।
২৭ মার্চ ওই ছাত্রীকে নিজ কক্ষে নিয়ে শ্লীলতাহানি করেন অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা। নুসরাতের মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন। ওই দিনই অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলাকে আটক করে পুলিশ। সে ঘটনার পর থেকে তিনি কারাগারে। সিরাজউদ্দৌলা কারাগারে থাকলেও বাইরে ছিল তারই অনুসারীরা।
৬ এপ্রিল সকালে আলিম পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় যান নুসরাত জাহান রাফি। মাদ্রাসাছাত্রী তার বান্ধবী নিশাতকে ছাদের ওপর কেউ মারধর করছে এমন সংবাদে তিনি ছাদে যান। সেখানে বোরকাপরা ৪-৫ জন তাকে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে করা শ্লীলতাহানির মামলা তুলে নিতে চাপ দেয়। অস্বীকৃতি জানালে তারা রাফির গায়ে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায়।
নুসরাত বলেছিল, গত কয়েকবছর ধরে তার মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ ওই মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের প্রশ্নপত্র দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে যৌন নির্যাতন করে আসছিল। সে নুসরাতের সাথেও এই রকম করেছিল।যদি বাংলাদেশে শিক্ষক কতৃর্ক যৌন নিপীড়ন খুব সাধারন একটি ঘটনা। শুধু শিক্ষক কতৃর্ক কেন পুরো দেশটাই যেন ধর্ষনের আর যৌন নিপীড়নের স্বর্গ রাজ্য হয়ে উঠেছে।লতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত প্রতি মাসে গড়ে ৫৫টির বেশি শিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে। প্রতিদিন সারাদেশের আনাচ-কানাচ থেকে ধর্ষণের সংবাদ আসে, কোন কোন সংবাদ বা নাম চলে আসে জাতীয় আলোচনায়। বাকী নাম থেকে যায় আড়ালেই। আমাদের অভ্যাস শিয়ালের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে, একজন ডাকলে পেছনে পেছনে আরও কয়েকজন ডাকে। না হলে নীরব থেকে যায়। যেন ধর্ষণের ঘটনাগুলো একইভাবে আমাদের আঘাত করার ক্ষমতা হারিয়েছে, দু-একটি ঘটনা আসে আলোচনায়-সমালোচনায়। অথবা মানুষ মনুষত্ববোধ ফিরে পায় কালে ভদ্রে।
অস্বাভাবিক ঘটনার প্রতিনিয়ত ঘটনার ফলে তা যেন আর অস্বাভাবিক নেই। এ কথা অনায়াসে বলা যায়, অনেক ধর্ষণের খবর গোপনেই থেকে যায়।সুতরাং বিচার চাওয়ার আওতায় আসতে গেলেও ঘটনাগুলোর থাকতে হয় বিশেষ বিশেষত্ব! বিচার চাইলেই কি শেষ? বাংলাদেশে ধর্ষণের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড আর ধর্ষণের কারণে মৃত্যু হলে তাতে মুত্যুদণ্ডের বিধান থাকলেও, বেশির ভাগ ঘটনায় বিচারের দীর্ঘসূত্রতা আছে। আবার বিচার হলেও রায় কার্যকর না হওয়া এখানে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যিনি ধর্ষণের শিকার হন, তিনিই সমাজে মুখ দেখাবেন কীভাবে তার উপায় খুঁজে বেড়ান। মনেই করে মানসম্মান বলতে তার আর কিছু নেই।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, প্রতিমাসে গড়ে ৫৫টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে । এ বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত শিশু ধর্ষিত হয়েছে ১৭৬টি। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে ৫৫টি করে এবং মার্চে ৬৬টি শিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে। সুতরাং মাসে গড়ে ৫৫টির বেশি শিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে। আর কেউ কেউতো ধর্ষণের শিকার হয়েই মুক্তি পান না, মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হয় তাকে। এ কথায় শেষ কথা নয়, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৫ জনকে। শঙ্কিত হবার বিষয় যে, এই পরিসংখ্যান অতীতের যেকোনো রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সংগঠনের একটি পরিসংখ্যান বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩০০-র বেশি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে।
নুসরাত এমন একটা সময়ে মারা গেল যে সময়ে দেশে একটি যৌন নির্যাতন বিরোধী ক্যাম্পেইন ‘গা ঘেষে দাঁড়াবেন না’ চলছিল আর তাতেই অনেকের গায়ে জ্বলুনি ধরে গেছে। অনেকের আসল চেহারা প্রাকাশিত হয়ে গেছে।ক্যাম্পেইনটা ছিল পাবলিক পরিবহনে মেয়েরা যে যৌন নির্যাতনের শিকার হয় তার বিরুদ্ধে। কিন্ত সেটা নিয়ে সে কি তুলকালাম। কেউ কেউ বিষয়টি নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করছে। ভাবটা এমন এই দেশে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে মেয়েরা কি ধরনের হেনস্তার শিকার হয় তার কিছুই তারা জানে না।
কারো কারো ভাষ্য, কেন মেয়েদের বুকে কাপড় নেই। তাদের যেহেতু বুকে কাপড়, সুতরাং তাদের হেনস্তা করাই যেতে পারেলেখাগুলিকে এডিট করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে যারা, তারা কিন্ত আদতে নিজেদেরই স্বরূপই প্রকাশ করছে। এই যে আপনারা যারা আজ এই ক্যাম্পেইনের বিরুদ্ধে কথা বলছেন, তাদের সাথে ওই মাদ্রাসা শিক্ষকের কি কোনো পাথর্ক্য আছে। আমি বলছি না যে আপনার ওই মেয়েটির গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন। কিন্ত আপনাদের আর তাদের মনস্তত্ত্বে কিন্ত খুব একটা ফারাক নেই।
বুঝলাম মেয়েরা পর্দা করছেনা, কিন্ত আপনি ভাই পর্দা করেন। ইসলাম ধর্মে তো চোখের পর্দা করার কথা বলা হয়েছে, তাহলে আপনার পর্দা থাকবেনা কেন। আচ্ছা, নুসরাত তো পর্দা করত, বোরকা পড়ত তাহলে সে কেন রেহাই পেলনা। তাহলে বিষয়টা কি দাড়াল, পর্দা করলেও মানুষরূপী পশুদের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়না।
তনু হত্যাও হ্যাঁ, তনুও তো পর্দা করতো। ২০১৭ সালের মার্চ মাসে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সুহাগী জাহান তনুকেও ধষর্ণ করার পর হত্যা করা হয়েছিল। পর্দা কি তনুকে বাঁচাতে পেরেছিল? পারেনি। আজ তিন বছর হয়ে গেল, তনু হুত্যার চার্জশীটটা পযর্ন্ত দাখিল করা হয়নি। আসলেই কি তনু হত্যার বিচার হবে?আচ্ছা, ছোট ছোট মেয়েগুলি যে ধষর্ণের শিকার হয় তাদের কি পর্দা করার কথা ধর্মে বলা হয়েছে। আর এই যে তিন, চার কিংবা পাচঁ বছরের মেয়েগুলি তাদের যৌন আবেদনটাই বা কোথায়। তাহলে ঘটনা কি দাঁড়ালো, মেয়েরা দিনের পর দিন নিপীড়ন নির্যাতনের শিকার হবে কিন্ত প্রতিবাদ করতে পারবে না।
নইলে, মেয়েরা যখন মি-টু প্লাটফর্মে নিজেদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে লাগল তা নিয়ে সে কি প্রতিক্রিয়া। সেই সময় নিপীড়নকারীর নয়, ওই মেয়েগুলির চরিত্র নিয়ে কথা শুরু হয়ে গেল। সেই নিপীড়কদের পক্ষে আমি আমার কাছের অনেক মানুষকে কথা বলতে দেখেছি যে আমার পায়ের তলের মাটি সরে গেছে।
এভাবে আর কত ঘটনা ঘটতে থাকবে? সমাজিক বিচার, রাষ্ট্রীয় বিচার সঠিক পথে পরিচালিত হবে না? সঠিক বিচার হওয়ার সংস্কৃতি চালু হওয়া জরুরী। নাহলে বাড়তে থাকবে নুসরাত, তনুদের নামের তালিকা আর আমাদের দীর্ঘশ্বাস ও হাহাকার