দেশে শিশু বলাৎকারের সংখ্যা বাড়ছে। গত ১১ মাসে ২২ শিশু এ অপরাধের শিকার হয়েছে, প্রতি মাসে গড়ে দুই জন। চলতি বছরে সবচেয়ে বেশি চারটি বলাৎকারের তথ্য প্রকাশিত হয়েছে বিদায়ী নভেম্বর মাসে। চলতি ২০২০ সালের দৈনিক পত্রিকাগুলো ঘেটে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বলাৎকারের প্রকাশিত সংখ্যার চেয়ে প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি। আর এ অপরাধের প্রকৃত চিত্র এবং এর প্রভাব আরও করুণ এবং ভয়াবহ। ভুক্তভোগী শিশুরা দীর্ঘদিন ধরে প্রচণ্ড মানসিক পীড়ায় থাকেন। অথচ অনেক দোষী অচিহ্নিত এবং বিচারের আওতার বাইরে থেকে যাচ্ছেন।
দেশে ধর্ষণের ঘটনা সম্প্রতি বেড়ে গেছে। এ অপরাধের শাস্তি আগের চেয়ে কঠোর করেছে আদালত। সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডও নির্ধারণ করা হয়েছে। এরই মধ্যে বলাৎকারের ঘটনাগুলোও সামনে আসছে। ভুক্তভোগী নারী ও মেয়ে শিশুরা যে ভয়াবহ শারিরিক ও মানসিক নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন সেই প্রায় একই ধরণের নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন ছেলে শিশুরা। আর বলাৎকারের ঘটনাগুলোর প্রায় সবগুলোই ঘটছে মাদ্রাসায়।
কঠোর আইন, প্রচার প্রচারণা ও উচ্চ আদালতের নানা ধরনের নির্দেশনার পরও এ ধরনের ঘৃন্য সহিংসতা কমানো যাচ্ছে না। আইনে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা না থাকাও এ ধরণের অপরাধের বিচারে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে গত ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের মাদ্রাসাগুলোতে বলাৎকারের শিকার হয়েছে ২১ জন শিশু। এরমধ্যে চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে চার ছাত্রকে বলাৎকার করেছে তাদের শিক্ষক। অভিযোগ এসেছে, ২-৩ মাস ভয় দেখিয়ে এরকম অপরাধমূলক কাজ করে আসছিলেন ওই শিক্ষক। ঢাকার সাভারে রুটিন করে এক শিক্ষার্থীকে বলাৎকার করে মাদ্রাসা শিক্ষক। আর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে মাদ্রাসার শিক্ষক এক শিশুকে বলাৎকার করে। এর বাইরে দেশের অন্যান্য স্থানে বলাৎকারের শিকার হয়েছে অন্তত ১৭ জন শিশু।
মাদ্রাসার বাইরে এ অপরাধের শিকার একজন। নেয়াখালীতে ওই শিশুকে বলাৎকার করে স্থানীয় এক ব্যবসায়ী।
সংশ্লিষ্টদের মতে, কন্যা শিশু ধর্ষণের পাশাপাশি গত কয়েক বছর দেশের জাতীয় সংবাদ মাধ্যমগুলোতে ছেলে শিশু ‘ধর্ষণের’ ঘটনাও নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে। এটি বলাৎকার নামে অভিহিত। শিশুর প্রতি সহিংসতা রোধে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন’ নামে একটি আলাদা কঠোর আইন রয়েছে। তবে বর্তমানে ছেলে শিশু ‘ধর্ষণের’ বিচার অনেক ক্ষেত্রেই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে না হয়ে প্রচলিত ফৌজদারি আইনের অধীনেই হচ্ছে।
অনেকে মনে করছেন, আইনের ব্যাখ্যা সম্বন্ধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও বিচার ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অস্পষ্ট ধারনা এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করছেন। আর তাতে করে প্রাপ্য বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে যৌন সহিংসতার শিকার ছেলে শিশুরা। এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন অনেকের মতে, বলাৎকারের ঘটনা যেভাবে বাড়ছে তাতে এ বিষয়ে কঠোর অবস্থান নেয়ার সময় এসেছে। মেয়ে শিশু ধর্ষণ এবং ছেলে শিশু বলাৎকারের বিচার একই আইনে হওয়া উচিৎ।
এদিকে পরিবার বা এলাকার প্রাপ্তবয়স্কদের কাছেও অনেক ছেলে শিশু যৌন হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। এ ধরনের অপরাধও আইনত ধর্ষণ হবে কিনা বা এর বিরুদ্ধে যে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া যায়- তা স্পষ্ট নয়। এ ধরনের অপরাধের বিচার নিয়ে সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা থাকা জরুরি বলে মত সংশ্লিষ্টদের।
এমন অপরাধের জন্য কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত বলে মনে করছেন মাদ্রাসা সংশ্লিষ্টরাও। রাজধানীর একটি কওমি মাদ্রাসার সাবেক ছাত্র তাজাম্মুল হোসেন বলেন, ‘এটি অবশ্যই ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ। এর কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত। মাদ্রাসার মতো জায়গাকে বিতর্কিত করার কোনো অধিকার তাদের নেই। ভবিষ্যতেও যাতে এ ধরনের অপরাধ না হয়, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র রাতুল বলেন, ‘এ ধরণের অপরাধ ধর্ষণের চেয়ে কম নয়। এ ঘটনাগুলো মাদ্রাসার মতো স্থানে ঘটছে, যা আরও বেশি স্পর্শকাতর। সেক্ষেত্রে এটি দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালে বিচার হওয়া দরকার।’
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক তাসলিমা ইয়াসমীন বলেন, প্রথমত আইনি ব্যাখ্যায় ছেলে শিশুর ধর্ষণকে ধারা ৯-এ অন্তর্ভুক্ত করা গেলেও প্রচলিত আইনে যে অস্পষ্টতা রয়েছে তা দূর করা প্রয়োজন। দণ্ডবিধির ধারা ৩৭৫-এ ধর্ষণের সংজ্ঞায় ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিকে বুঝাতে নারীর পাশাপাশি ‘শিশু’ শব্দটি যুক্ত করতে হবে। একই সাথে দণ্ডবিধির ৩৭৫-এর সংজ্ঞায় ‘পেনেট্রেশন’ বা ‘প্রবিষ্ট করা’ এই শব্দটির একটি যথাযথ ব্যাখ্যা অন্তর্ভুক্ত করা উচিত, যাতে সমলিঙ্গের মাধ্যমে যৌন সঙ্গমকেও ‘পেনেট্রেশন’ বলা যায়।
তিনি বলেন, এর পাশাপাশি ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে’ ‘শিশু’র সংজ্ঞায় ছেলে, মেয়ে বা অন্য কোন লিঙ্গ পরিচয়ের অনধিক ১৬ বছর বয়সী শিশুর কথা সুনির্দিষ্ট করে উল্লেখ করা যেতে পারে, যেকোন ধরনের অস্পষ্টতা দূর করার জন্য। যেহেতু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, বিচার ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই এ বিষয়টি নিয়ে স্পষ্ট ধারণা রাখেন না। তাই থানা পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্য থেকে শুরু করে আইনজীবী, বিচারক এবং পাবলিক প্রসিকিউটরদেরকেও এই বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া প্রয়োজন।
তার মতে, এ ধরণের অপরাধের বিষয়ে জাতীয় পর্যায়েও সচেতনতামূলক পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। এতে করে ছেলে শিশুও যে ধর্ষণের বিচারের বাইরে নয়, সেটি সাধারণের কাছে স্পষ্ট হবে। সর্বোপরি ধর্ষণকে ধর্ষণই বলতে হবে, বলাৎকার নামকরণ করে এই অপরাধের মাত্রা কমানোর কোন সুযোগ নেই বলেও মনে করেন তিনি।
উৎসঃ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২০ সকাল ৮:৪১