স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তীব্র বাদানুবাদের এক পর্যায়ে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে মুখে তিন তালাকের ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক দম্পতিকে গত চারমাস যাবত কার্যত একঘরে করে রেখেছে গ্রামবাসী।
ঘটনাটি ঘটেছে বাংলাদেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার ৫ নম্বর সুন্দরদীঘি ইউনিয়নের ছলিমপুর গ্রামে।
গ্রামবাসী ঐ দম্পতিকে এমনভাবে একঘরে করেছে যে তাদের পরিবারের সদস্য এবং আত্মীয়-স্বজনদেরও হুমকি দেয়া হয়েছে যে যোগাযোগ করলে তাদেরও একঘরে করা হবে।
গ্রামের কোন দোকান থেকে সে দম্পতির কাছে পণ্য বিক্রি করা হয় না এবং তাদের কোন কাজও দেয়া হয়না বলে অভিযোগ উঠেছে।
কী ঘটেছিল?
ছলিমপুর গ্রামের আয়নাল হক ও জামিরন বেগমের প্রায় ৩৫ বছরের সংসার।
তারা চার সন্তানের পিতা-মাতা। এর মধ্যে তিন সন্তানের বিয়ে হয়েছে।
দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করে সংসারের খরচ চালান আয়নাল হক।
চলতি বছরের এপ্রিল মাসে রোজার সময় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়।
ঝগড়ার এক পর্যায়ে আয়নাল হক মুখে মুখে তার স্ত্রীর প্রতি তালাক শব্দটি উচ্চারণ করেন। দ্রুত এ বিষয়টি গ্রামে জানাজানি হয়ে যায়।
আয়নাল হক বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “সাংসারিক ব্যাপার নিয়ে পাঁচ-সাত ধরে ঝগড়া-ঝাটি করতে করতে করতে ঐদিন মাথা গরম হয়া গেছিল।”
বিষয়টি নিয়ে গ্রামে বেশ সাড়া পড়ে যায়। গ্রামের নেতৃস্থানীয় কিছু ব্যক্তি বলেন, এখন থেকে স্বামী-স্ত্রী একসাথে বসবাস করতে পারবে না।
“এটা নিয়া সমাজে মিটিং বসছিল। একজন হুজুর বললো, ওর হিল্লা বিয়া দিতে হবে, ওর সুরুত( চেহারা) দেখা যাবে না। এটা তালাক একবারে হয়া গেছে,” বলেন জামিরন বেগম।
“আমার স্বামী বললো ওর সাথে ৩০-৩৫ বছরের সংসার। চারটা বাচ্চা কাচ্চা, নাতিপুতি আছে। ওরে আমি কিভাবে বাদ দেই?”
কয়েকদিন পরে গ্রামের বাইরে আরো কয়েকজন মাওলানার কাছ থেকে মতামত নেন এই দম্পতি। তারা বলেছেন, এই তালাক কার্যকরী হবে না।
কিন্তু তারপরেও বিষয়টিতে আশ্বস্ত হতে পারেননি সমাজের মানুষ। তাদের সন্তুষ্ট করার জন্য এই দম্পতি অন্যত্র গিয়ে আবারো বিয়ে করেন।
জামিরন বেগম বলেন, “সমাজে উঠতে হবে। সেজন্য খানসামার একজন আলেমের কাছে গিয়ে আমরা আবারো বিয়ে পড়ছি। ”
“আমাকে বাড়ি থেকে বাইর করে দিতে বলছে। আমি বলছি, আমি বাইর হবো না। এখন আমাদেরকে সমাজে বয়কটে রাখছে। দোকানে যাইতে পারে না। একদিন দোকানে যাওয়ার পরে বলছে, আপনি দোকানে আইসেন না।”
সে দম্পতির বড় ছেলে ওমর ফারুকের বাড়ি পাশেই। কিন্তু গ্রামের সমাজের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি তার বাবা-মায়ের সাথে কথা বলতে পারেন না।
গ্রামের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা তাকে সতর্ক করে দিয়েছেন, যদি তিনি সিদ্ধান্ত অমান্য করেন তাহলে তাকেও একই পরিণতি ভোগ করতে হবে।
ওমর ফারুক, “আমার আব্বা-আম্মা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে আবারো বিয়ে করে একত্র হয়ে গেছে। আমার আব্বা-আম্মার সাথে আমি কথা বলতে পারি না। যদি কথা বলি, তাহলে আমাকেও সমাজ থেকে বিরত রাখবে আর ৫০০ টাকা জরিমানা করবে।”
গ্রামের নেতৃস্থানীয়রা যা বলছেন
স্থানীয় সাংবাদিকরা বলছেন, পঞ্চগড় জেলার বিভিন্ন গ্রামে সমাজ ব্যবস্থা নির্ভর করে স্থানীয়ভাবে যারা প্রভাবশালী তাদের মতামতের উপর।
আয়নাল হক এবং জামিরন বেগম দম্পতির বিষয়টি নিয়ে গ্রামে যারা সোচ্চার ছিলেন তাদের মধ্যে শাহজাহান আলী অন্যতম।
মি. আলী বলেন, গ্রামের সবাই মিলে সে দম্পতিকে বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা কোন একক ব্যক্তির সিদ্ধান্ত নয় বলে তিনি উল্লেখ করেন।
“কেউ বলে নাই যে হিল্লা বিয়া দিতে হবে। মুন্সির কাছ থেকে সেও (আয়নাল হক) ফতোয়া নিছে, আমরাও ফতোয়া নিছি। হুজুররা বলছে, এটা তালাক হয়ে গেছে,” বলেন মি. আলী।
“তারা নাকি কোথায় গিয়ে আবারো বিয়া করছে। আমরা বলছি, বিয়া করছো ভালো কথা। আমাদের কাগজ দেখাও। ওরা কোন কাগজ দেখাইতে পারে নাই।”
তিনি দাবি করেন, বিষয়টা নিয়ে সমাজে যাতে কোন বিশৃঙ্খলা না হয় সেজন্য তাদের বয়কট করা হয়েছে।
“আমাদের সমাজে ওরে আবদ্ধ রাখা হইছে। উনি যদি অন্য সমাজে যায়, তাহলে আমরা তো আর বাধা দিবো না। একটা লোকের জন্য সমাজে বিশৃঙ্খলা করা যায় না কি?”
কী বলছে প্রশাসন?
বিষয়টি নিয়ে গত সোমবার পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করেন জামিরন বেগম।
সেখানে ১০জন গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। যাদের মধ্যে শাহজাহান আলীর নামও রয়েছে।
সে অভিযোগে বলা হয়, বিবাদীদের কারণে তাদের একঘরে করে দিয়েছেন এবং তাদের স্বাভাবিক জীবন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
দেবীগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা প্রত্যয় হাসান বিবিসি বাংলাকে জানান, তিনি এ অভিযোগটি পেয়েছেন।
মি. হাসান বলেন, “বিষয়টি নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আশা করি এটি দ্রুত সমাধান করা যাবে। এ বিষয়গুলো সমাধানের জন্য ইউনিয়ন পরিষদে আরবিট্রেশন কাউন্সিল আছে,”
“সমস্যাটা হচ্ছে সামাজিক। এটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাহেবরা ভালোভাবে সমাধান করতে পারেন।”
সুত্র: বিবিসি বাংলা
2 comments
দেশের কিছু সুবিধাবাদী নেতারা এ ধরনের কাজ করে থাকে এবং হুজুরদের ঘাড়ে বন্ধুক রেখে এই কাজগুলি করে তারা।
বাঘের কাছে ছাগল পালন করতে দেওয়া আর স্থানীয় চেয়ারম্যানের কাছে এ ধরনের বিচারের দায়িত্ব দেওয়া সমান কথা