বাংলাদেশে গুমের শিকার বা নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের অনেকের পরিবারের সদস্যরা আবারও তাদের স্বজনদের ফিরিয়ে দেয়া এবং ঘটনাগুলো তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।
গুম বিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস উপলক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর একটি সংগঠন মায়ের ডাক এবং বিরোধী দল বিএনপি আয়োজিত ঢাকায় সোমবার এক মানবনবন্ধন কর্মসূচিতে তারা অভিযোগ করেছেন, স্বজন নিখোঁজ থাকায় সম্পদ এবং ব্যাংকে থাকা অর্থের অধিকারের ক্ষেত্রেও বছরের পর বছর ধরে আইনি জটিলতায় পরিবারগুলোর সংকট বেড়েছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ গুমের ঘটনার কারণে বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু উর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপের জন্য বিভিন্ন দেশের প্রতি আহবান জানিয়েছে।
তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, “আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গুমের কোন ঘটনা ঘটেনি।”
‘আর গুমের ভার বহন করতে পারি না।’
গুমের শিকার ব্যক্তিদের একটা বড় অংশ বিএনপি এবং বিরোধী দলের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল বলে বিএনপির দাবি।
এই ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো মায়ের ডাক নামের একটি সংগঠন গড়ে তুলেছে। সংগঠনটির উদ্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর সদস্যরা নিখোঁজ স্বজনদের ছবি নিয়ে জড়ো হয়েছিলেন ঢাকায় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে।
সেখানে একের পর এক তাদের বক্তব্যে স্বজনকে ফিরে পাওয়ার আকুতি এবং তাদের কষ্টের বিবরণ অন্য রকম এক পরিবেশ তৈরি করেছিল।
আট বছর আগে ২০১৩ সালে গুমের শিকার ঢাকার ছাত্রদলের একজন নেতা।
তার মা ঐ অনুষ্ঠানে বলেন, “আমরা আর গুমের ভার বহন করতে পারি না। কতদিন এই কষ্ট সহ্য করবো।”
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৭ সাল থেকে ২০২১ সালের ২৫ শে অগাষ্ট পর্যন্ত সময়ে ছয়শোর বেশি ব্যক্তি গুমের শিকার হয়েছেন। গত এক বছরে গুম হয়েছে ৩২জনের মতো।
২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের আগের বছরে গুমের ঘটনা বেড়ে যায় বলে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে।
পরিবারগুলোর নানামুখী সংকট
পুরোনো ঢাকার সৈয়দা শাম্মী সুলতানা অভিযোগ করেছেন, বিএনপির রাজনীতি করায় তার স্বামী গুম হয়েছেন ২০১৩ সালে।
আট বছর ধরে তিনি পুলিশ র্যাবের কাছে ঘুরে কোন সহযোগিতা পাননি।
তিন বলেন, তার স্বামী নিখোজ থাকায় সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করাতে গিয়েও সংকটে পড়েছিলেন।
“কাউকে বলা যায় না যে আমার সন্তানের বাবা নিখোঁজ হয়ে আছে। স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং ওর বন্ধুরা জানে যে, ওর বাবা বিদেশে আছে।”
ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা, সম্পদের অধিকার পেতে জটিলতা
ঢাকার মিরপুর এলাকার নাসরিন জাহান প্রীতির স্বামী নিখোঁজ হয়েছেন দুই বছর আগে ২০১৯ সালে।
একদিকে তার স্বামীর খোঁজ মিলছে না, অন্যদিকে সম্পদের অধিকার নিয়ে কোন দাবি তুলতে পারছেন না।
এমনকি তিনি ব্যাংকে থাকা টাকার জন্য ধর্না দিয়েও কোন সমাধান পানি।
“আমার স্বামীর ব্যাংক ব্যালেন্স আছে এবং আমার আমানত হিসাব বা ডিপিএসগুলোও তার অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করেছিলাম নিখোঁজ হওয়ার একমাস আগে” বলেন তিনি।
তিনি জানিয়েছেন, তার স্বামী নিখোঁজ হওয়ার পর দুই বছর ধরে সেই অর্থ পাওয়ার জন্য তিনি ব্যাংকের দ্বারে বার বার গিয়েছেন। কিন্তু টাকা পাননি।
“ব্যাংক আমাকে বলে যে ডেথ সার্টিফিকেট বা কোন প্রমাণ ছাড়া টাকা দেয়া যাবে না। এখন মানুষটাও নাই এবং আমাদের টাকাও নাই। এটা কত কষ্টের” বলেন নাসরিন জাহান প্রীতি।
আইনে বলা আছে, কোন ব্যক্তির সাত বছর খোঁজ না মিললে তখন তার সম্পদ বা অর্থের ওপর পরিবার অধিকার পাবে।
ফলে কোন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে গুমের শিকার ব্যক্তির সম্পদ বা ব্যাংকে থাকা অর্থের ওপর অধিকার পেতে সাত বছর অপেক্ষা করতে হবে।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেছেন, নিখোঁজ ব্যক্তির স্ত্রী যদি আবার বিয়ে করতে চান, সেজন্যও তাকে সাত বছর অপেক্ষা করতে হবে।
বিএনপির অভিযোগ
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মনে করেন, সম্পদের ওপর অধিকার না পাওয়ার আইনি জটিলতা পরিবারগুলোকে আরও বেশি সংকটে ফেলেছে।
“সবচেয়ে করুণ এবং হৃদয় বিদারক হচ্ছে, তারা বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে-সে সম্পর্কে তারা কিছু জানে না।
“তাদের ছেলে মেয়েদের নিয়ে ভবিষ্যৎ জীবনে অনেক সমস্যার মুখোমুখি তারা হচ্ছে” বলেন মি: আলমগীর।
তিনি অভিযোগ করেন যে, সরকার গুমের ঘটনাকে কোন গুরুত্ব দেয় না।
“কিন্তু এটা ফ্যাক্ট যে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতেই তারা গুম হয়েছে” মন্তব্য বিএনপি মহাসচিবের।
ক্ষতিগ্রুস্ত পরিবারগুলো এবং বিএনপি গুমের ঘটনাগুলোর দায় চাপাচ্ছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সরকারের ওপর।
বাংলাদেশি মানবাধিকার সংস্থাগুলোর হিসাব অনুযায়ী, ২০০৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত ছয়শ’র বেশি মানুষ জোরপূর্বক গুমের শিকার হয়েছেন।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক বিবৃতিতে বলেছে, গুমের ঘটনা অব্যাহত থাকলেও বাংলাদেশ সরকার বার বার অস্বীকার করছে।
সংস্থাটি যুক্তরাষ্ট্র এবং জাতিসংঘকে বাংলাদেশের বআইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করার দাবি জানিয়েছে।
সরকার যা বলছে
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এসব অভিযোগ মানতে রাজি নন।
তিনি বলেছেন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুমের কোন ঘটনার সাথে জড়িত নয়।
“আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাউকে গ্রেপ্তার করলে তাকে আদালতে নিয়ে সোপর্দ করে” বলেন মি: খান।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মি: খান পাল্টা অভিযোগ করেন যে, “এরা নিজেরাই ইচ্ছা করে নিখোঁজ বা গুম হয়ে যায়।”
এমন বক্তব্যের ক্ষেত্রে তার ব্যাখ্যা হচ্ছে, “কেউ অর্থনৈতিক দিক থেকে দেউলিয়া হয়ে গেলে নিখোঁজ হয়, কেউবা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে নিজেই আত্নগোপন করে।”
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, এ ধরনের যারা গুম হয়েছিল বলে বলেছিল, তাদের বেশির ভাগকেই উদ্ধার করে আত্নীয় স্বজনের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়া হয়েছে।
“দু’একটি ঘটনায় যারা এখনও উদ্ধার হয়নি, তাদরেরও উদ্ধার করা সম্ভব হবে বলে তিনি মনে করেন।
তবে পরিবারগুলো বলছে, এপর্যন্ত গুমের ঘটনাগুলোতে তাদের মামলা নেয়া হয়নি, ফলে তাদের সাধারণ ডায়রি বা জিডি করতে হয়েছে।
অন্যদিকে, গুমের শিকার ব্যক্তিদের বছরের বছর যাদের খোঁজ মিলছে না, তাদের পরিবারের সদস্যদের সম্পদের অধিকারের ব্যাপারে আইনি জাটিলতা নিরসনে কোন উদ্যোগ নেয়া হবে কিনা-সে ব্যাপারেও সরকার থেকে পরিস্কার কোন বক্তব্য মেলেনি।
সুত্র: বিবিসি বাংলা