একটি দৈনিকে ১১ সেপ্টেম্বর ‘নারী পাচারে নতুন ফাঁদ’ শিরোনামে যে সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে, তা পুনর্বার আমাদের সমাজ বাস্তবতার গাঢ় অন্ধকারের দিকটিই তুলে ধরেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘নারী পাচারকারীরা কৌশল পাল্টে এখন মাজারকে নিশানা করেছে। দেশের বিভিন্ন মাজারে আসা-যাওয়া করা নারী, যারা বয়সে তরুণী তাদের চাকরির প্রলোভন দিয়ে ভারতে পাচারের নতুন ঘটনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে এসেছে।’
আমরা জানি, আমাদের সমাজ বাস্তবতায় প্রতারণার ফাঁদগুলো প্রায় ধারাবাহিকভাবে তৈরি হওয়ার মহূল কারণ, যে কোনো নেতিবাচক কিংবা অপরাধমূলক ঘটনার দ্রুত দৃষ্টান্তযোগ্য আইনি প্রতিকার না হওয়া। শুধু নারীই নয়, বর্তমান বাস্তবতায় মানব পাচার ভয়াবহ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভিবাসন বিশেষজ্ঞ কিংবা সমাজ বিজ্ঞানীরা এ সমস্যার কারণগুলো উদঘাটন করে ইতোমধ্যে রাষ্ট্রশক্তির করণীয় সম্পর্কে অনেক সুপারিশ উপস্থাপন করলেও মানব পাচারের মতো ভয়াবহ ব্যাধি থেকে আমাদের মুক্তি মিলছে না। বিশেষ করে নারী পাচারের ভয়াবহতা ক্রমাগত নতুন নতুন দিক উন্মোচন করছে, যে দিকগুলো গভীর ক্ষত ও স্পষ্ট করছে।
অনেকেরই হয়তো স্মরণে আছে, টিকটক-লাইকির মতো প্রযুক্তির কল্যাণে অ্যাপ ব্যবহার করে নাটক-সিনেমার অভিনয়ের কথা বলে তরুণীদের ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পাচারের ঘটনায় নিকট অতীতে কয়েকজনকে আটকের পর অন্ধকার জগতের ঠিকানা মিলেছিল। ভারতের বেঙ্গালুরুতে এক বাংলাদেশি তরুণীর ওপর নির্যাতনের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর সংঘবদ্ধ নারী পাচারচক্রের সন্ধান মিলেছিল। তবে ঐ অনুসন্ধান নতুন কিছু নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো কোনো অঘটন ঘটার পর তত্পর হয়ে ওঠে, কোনো কোনো দুষ্কর্মকারী ধরাও পড়ে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এক পর্যায়ে আবার প্রায় সবকিছু মিইয়েও যায়। মাজারকে নিশানা করে নারী পাচারকারীদের কৌশল পাল্টানোর উন্মোচিত ঘটনাটি এরই খ্লিত চিত্র। মাজারকেন্দ্রিক পাচারকারী এই চক্র নারীদের ভারতের আজমির শরিফ দরগাহ জিয়ারত করে পুণ্যলাভ করার বা চাকরি দেওয়ার কথা বলে ফাঁদে ফেলে। এভাবে পাচারের শিকার দুই তরুণীকে বেসরকারি সংগঠন ‘রাইটস যশোর’-এর সহায়তায় তাদের উদ্ধার করা হয়। বের হয়ে আসে অন্ধকার জগতের অনেক অজানা অধ্যায়।
অনেকেরই হয়তো এও মনে আছে, নিকট অতীতে সিরিয়া থেকে পাচারকৃত কয়েকজন নারীর ফিরে আসার ঘটনাও। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ সিরিয়ায় পাচারকৃত নারীদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর যোদ্ধাদের হাতে তুলে দেওয়ার খবরও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত-প্রকাশিত হয়েছিল। নারী পাচারের সঙ্গে দেশ-বিদেশের অনেক চক্র যে জড়িত এবং তাদের নেটওয়ার্কও যে অনেক বিস্তৃত এই খ্লিত চিত্রগুলো এরই সাক্ষ্যবহ। আমরা যখন দেখি মানব পাচারের সঙ্গে জাতীয় সংসদ সদস্যের সম্পৃক্ততা রয়েছে, তখন উদ্বেগ-হতাশা-প্রশ্নের পরিধি ক্রমেই বিস্তৃত হয়। সংসদ সদস্যপদ বাতিল হওয়া কুয়েতে গ্রেপ্তারকৃত এবং দ্লিত শহিদ ইসলাম পাপলু এরই দৃষ্টান্ত। ২০২০ সালে মানব পাচার তথা টিআইপি বা বৈশ্বিক ট্রাফিকিং ইন পারসন সূচকে বাংলাদেশ একধাপ এগিয়ে ছিল। কিন্তু সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে মানব পাচার বিশেষ করে নারী পাচারে যে চিত্র উঠে আসছে তাতে ট্রাফিকিং সূচকের মানদ্লে এখন বাংলাদেশের অবস্থান কী হবে, তা এক কঠিন প্রশ্ন।
আমাদের দেশের নারীদের যারা বিভিন্ন দেশে বিক্রি করছে, পাচার করছে, তাদের সম্ভ্রম ও জীবন বিপন্ন-বিপর্যস্ত করছে তারা কারা? এ প্রশ্নের উত্তর নিশ্চয়ই জটিল কিছু নয়। প্রথমত, এই ভয়াবহ চিত্র ক্রমেই প্রকট রূপ নিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী, ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ও অতিদায়িত্বশীল সংস্থাগুলোর অনেকের ব্যর্থতার কারণে। যদি তাদের দায়বদ্ধতা-জবাবদিহি ব্যবস্থা রাষ্ট্র যথাযথভাবে নিশ্চিত করতে পারত, তাহলে এই ভয়াবহতার মুখোমুখি হয়তো আমাদের হতে হতো না। দ্বিতীয়ত, সমাজের একশ্রেণির মানুষের মারাত্মক অসচেতনতাও এ জন্য দায়ী। তরুণী-যুবতী কিংবা একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারীর টিকটক-লাইকির মাধ্যমে খ্যাতিমান বনে যাওয়া কিংবা উন্নত জীবনের প্রতারণার ফাঁদ পাতা হাতছানি তাদের প্রলুব্ধ করে বলেই গাঢ় অন্ধকারের বিস্তৃতি ঘটছে।
নারী পাচারের উল্লিখিত তথ্যগুলো একদিকে যেমন ভীতিকর, অন্যদিকে আমাদের আর্থসামাজিক অগ্রগতি ম্লান করে দিচ্ছে। দেশে এ-সংক্রান্ত আইন থাকলেও এর প্রয়োগে যে ঘাটতি রয়েছে বিদ্যমান বাস্তবতা এও স্পষ্ট করে দেয়। এই ভয়াবহ মানবতাবিরোধী দুষ্কর্মে যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করে কঠোর আইননানুগ ব্যবস্থা নেওয়া নিশ্চয়ই কঠিন কিছু নয়। সংবাদমাধ্যমেই জানা গেছে, দেশে বছরে এ ধরনের মামলা নিষ্পত্তির সংখ্যা ৫-৬টি! তাও আবার যারা বিচারের মুখোমুখি হচ্ছে তারা চুনোপুঁটি। মূল হোতারা থেকেই যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এ তো গেল নারী পাচার রোধে আইনগত দিক। এর একটি সচেতনতার দিকও রয়েছে, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতির কারণে অপরাধচক্র এর অপব্যবহার করছে। তৈরি করছে প্রতারণার নতুন নতুন ফাঁদ। মানুষের সচেতনতা ও আইনের সঠিক প্রয়োগই কেবল পারে এই অন্ধকার ঘোচাতে। পাচারকারীরা যেসব রুটকে নিরাপদ মনে করে বেছে নেয়, সেসব রুটে বিশেষ নজর দেওয়ার পাশাপাশি মানবতার শত্রুদের আইনের জালে আটকিয়ে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা না গেলে সমাজের এই দুষ্টক্ষত কোনোভাবেই দূর করা যাবে না। অনেকেই হয়তো দুবাইয়ে নারী পাচারকারী চক্রের অন্যতম সদস্য সেই আজম খানের কথা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি। এমন আজম খানের সংখ্যা (যে শুধু একাই সহস্রাধিক নারী পাচার করেছে) সমাজে কম নয়। তারা যে ছায়াতলে বেড়ে উঠছে হাত দিতে হবে সেখানে।
অন্ধকারের গ্রাসে জীবন হারিয়ে যাচ্ছে, পণ্য সমতুল্য হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে, বিপন্ন-বিপর্যস্ততার গাঢ় ছায়ায় তলিয়ে যাচ্ছে সব সম্ভাবনা। এই অন্ধকার দূর করা মোটেও সহজ নয়, যদি সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সবার যূথবদ্ধ প্রয়াস-প্রত্যয়ের বাস্তবায়ন করা না যায়। একই সঙ্গে সামাজিক পরিসরে সচেতনতার বোধ পুষ্ট করতে হবে। সরকার, প্রশাসনের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা, জনপ্রতিনিধি, সামাজিক সংগঠনের সবাইকে দাঁড়াতে হবে এই রাহুগ্রাসের বিপরীতে। ভয়ংকর অন্ধকার থেকে যারা ফিরে আসতে পারছে কিংবা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে তাদের পুনর্বাসনেও সরকারের তরফ থেকে নিতে হবে ব্যাপক কর্মপরিকল্পনা। আজম খান কিংবা টিকটক হূদয়রা এই সমাজে জন্ম নেয় এবং বেড়ে ওঠে কীভাবে—এর অনুসন্ধানও সমভাবেই জরুরি।
সুত্রঃ ইত্তেফাক
7 comments
এদের সবাইকে ক্রসফায়ার দেওয়া হোক তাহলে আরো অনেকে সতর্ক হয়ে যাবে এবং প্রশাসনকে আরো সচেতন হতে হবে বিশেষকরে মানব পাচার ঠেকাতে
আসলেই এদের বিচার হয়না দেখে এরা এত সাহস পাই তাই এদের কে জনগণের হাতে উঠিয়ে দেওয়ার দরকার এবং ইসলামী নীতিমালা বিচার করার দরকার তাহলেই আর কখন এই ধরনের মানব পাচার হবে না আজ এই কাজ ধরেন আফগানিস্তানে হত তাহলে কি হত
একশত সত্য, এদেরকে তিন থেকে ছয় মাসের ভিতর জামিন দিয়ে দিবে। জামিনে বেরিয়ে আবার একই কর্ম করবে। অসাধু উকিল আর অসাধু বিচারকদের বিরুদ্ধে যে পর্যন্ত ব্যবস্থা না নিবে, সে পর্যন্ত এদেরকে ধরে কোনো ফল হবেনা।
আমার বুঝে আসেনা এতো নারী পাচার খবর আমরা জানার পরও কিভাবে বিদেশে মা বোনদের পাঠানো চেষ্টা করি
Nare pachar karedar ak matro saste metto dondo hoa ochit.
কী ভয়ানক ! ও আল্লাহ, তুমি কোথায় আছো ? এই অসহায়দের সহায়দের তুমি সহায় থেকো !
খুব দ্রুত এ ধরনের সকল অপরাধকারীদের আইনগতভাবে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করা হোক নয়তো এরা থামবে না