পুরান ঢাকা। তীব্র যানজট। দুপুর গড়িয়ে বিকাল। বংশালে এক রুমের ছোট্ট বাসা। আট বছরের শিশু সাদিকা সরকার সাফা। জন্মের দু’মাস পর থেকে কখনো বাবার চেহারাটা দেখেনি সে। একে একে কেটে গেছে যন্ত্রণাময় দীর্ঘ আটটি বছর। এতদিনে সে বুঝতে শিখেছে বাবার আদরের শূন্যতা।
নিখোঁজ বাবার কথা বলতেই ছলছল করে ওঠে অবুঝ শিশুর মায়াবি দুই চোখ। গাল বেয়ে ঝরে ফোঁটা ফোঁটা নোনা জল। শিশুটির এই বোবা কান্নায় স্পষ্ট ফুটে ওঠে পিতৃহীন শৈশবের অব্যক্ত গল্প। বোনের কান্না দেখে পাশে বসা কিশোর বয়সী ভাইয়ের চোখও ছলছল করছে। চোখের পানি মুছে চাপা কষ্ট লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে ছেলেটি। অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে গেছে তার পড়ালেখা। জীবনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি তারা। নিখোঁজ সাবেক ছাত্রদল নেতা মাহফুজুর রহমান সোহেলের সন্তান তারা। বংশাল থানা ছাত্রদলের এই সাবেক সহ-সভাপতিকে শাহবাগ থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় প্রকাশ্যে-দিনে দুপুরে, শত শত লোকের সামনে থেকে। তবে সোহেল একা নন। তার সঙ্গে তুলে নেয়া হয় চঞ্চল, পারভেজ ও জহিরকেও। সাদা পোশাকের লোকজন তাদের হ্যান্ডকাফ পরিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ভেবে তাদের কাছে ভিড়েনি উপস্থিত জনতার কেউই। শাহবাগ থানার এত কাছ থেকে কোনো অপহরণকারী চারজন মানুষকে এভাবেই হ্যান্ডকাফ পরিয়ে তুলে নিয়ে যাবে ঘুণাক্ষরেও বিশ্বাস করতে পারেননি প্রত্যক্ষদর্শীরা। কয়েক মিনিট পর তাদের হাত-পা বেঁধে দু’টি সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। এরপর আর হদিস মেলেনি তাদের। আজও তারা নিখোঁজ।
স্বামী সোহেল নিখোঁজের লোমহর্ষক বর্ণনা মানবজমিনের কাছে তুলে ধরেছেন তার স্ত্রী শিল্পী। জানান, ২০১৩ সালের ২রা ডিসেম্বর। সকালের দিকে বংশালের বাসা থেকে বেরিয়ে যান সোহেল। দুপুরের দিকে তাকে ফোন করি। তখন তিনি জানান, বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে আছি। চিন্তা করো না। এই বলে ফোন কেটে দেন। এটাই ছিল স্বামীর সঙ্গে তার শেষ কথা। বিকালের দিকে মান্নান নামের এক ভাতিজা দৌড়ে বাসায় আসেন। বলেন, চাচি সোহেল চাচার খবর জানেন? চাচাকে নাকি এরেস্ট করেছে পুলিশ। পাল্টা প্রশ্ন করেন- কোথা থেকে এরেস্ট করেছে, তোমাকে কে বলেছে? জবাবে মান্নান বলেন, শাহবাগের শিশুপার্কের সামনে থেকে। সোহেল চাচার সঙ্গে যিনি ছিলেন তিনি জানিয়েছেন। চারজনকে একসঙ্গে নাকি হাতকড়া পরিয়ে তুলে নিয়ে গেছে। কিন্তু তাদের সঙ্গী পাভেল, মিটু নামে আরও দু’জন ছিলেন। তারা ভাগ্যক্রমে পালিয়ে আসতে পেরেছেন। খবরটি শোনার পরই পাশের ঘরে গিয়ে শ্বশুর শামসুর রহমান ও দেবর সাঈদকে ঘটনাটি জানান। সঙ্গে সঙ্গে সাঈদ তার ভাই সোহেলের মোবাইলে ফোন দেন। ফোনটি রিসিভ করার সঙ্গে সঙ্গেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে সোহেলের কান্নার শব্দ। মাগো মাগো আর্তনাদ করছিলেন তিনি। সাঈদ তার ভাইকে বারবার প্রশ্ন করছিলেন- আপনাকে কে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব, পুলিশ না ডিবি। কিন্তু সেই প্রশ্নের উত্তর আর দিতে পারেননি সোহেল। কেটে যায় ফোনের সংযোগ। বন্ধ হয়ে যায় সোহেলের মোবাইল ফোনটি। সেই থেকে আজও বন্ধ তার মোবাইল নাম্বারটি।
এদিকে ভাইয়ের খোঁজে বাবাকে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই শাহবাগে ছুটে যান সাঈদ। কথা বলেন ঘটনাস্থলের প্রত্যক্ষদর্শী ফুলের দোকানিদের সঙ্গে। এক দোকানি জানান, বিকাল ৩টার দিকে শিশুপার্কের সামনে কালো গ্লাসের দু’টি সাদা মাইক্রোবাস এসে থামে। গাড়ি দু’টি থেকে ৬-৭ জন সাদা পোশাকের লোক নেমে আসেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রথমে দু’জনকে আটক করে হাতকড়া পরিয়ে গাড়ির সামনে দাঁড় করিয়ে রাখেন। একই সময় তাদের আরেকটি টিম একইভাবে আরও দু’জনকে আটক করে হাতকড়া পরায়। এরপর চারজনকে গাড়িতে তুলে হাত-পা বেঁধে ফেলে। অপহরণকারীদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ভেবে তাদের কাছে ভিড়েনি কেউ। দ্রুত গাড়ি দু’টি ঘটনাস্থল ত্যাগ করে।
বিকালেই সোহেলের খোঁজে শাহবাগ থানায় যান তার বাবা শামসুর রহমান। গ্রেপ্তারের বিষয়টি অস্বীকার করে তারা। শাহবাগ থানায় না পেয়ে যান মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে। সেখান থেকেও পান হতাশার খবর। ফের ছোটেন র্যাব সদর দপ্তরে। হদিস মেলেনি সেখানেও। এভাবে বেশ কয়েকদিন ছেলের সন্ধানে হন্যে হয়ে রাজধানীর বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দপ্তরে খুঁজে বেড়ান বৃদ্ধ বাবা।
এরপর বাধ্য হয়ে বংশাল থানায় জিডি করেন পিতা শামসুর রহমান। জিডির তদন্ত করতে বাসায় আসে পুলিশ। কীভাবে নিখোঁজ হয়েছে তার বিস্তারিত তথ্য নিয়ে যায়। দৃশ্যমান তদন্ত এতটুকুই।
এদিকে পুত্রের সন্ধানের জন্য দেশের বিভিন্ন কারাগার, হাসপাতালে খোঁজ নেন পিতা শামসুর রহমান। কিন্তু কোথাও পুত্রের কোনো হদিস পাননি। পুত্র শোকে এক পর্যায়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। গত বছরের নভেম্বরে না ফেরার দেশে চলে যান শামসুর রহমান।
ওদিকে স্বামীর পর শ্বশুরকে হারিয়ে অবুঝ দুই সন্তান নিয়ে অথৈ সাগরে পড়েছেন শিল্পী। সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভুগছেন অনিশ্চয়তায়। শিল্পী বলেন, আমার বাবা-মা বেঁচে নেই। আমার স্বামী ছোট্ট একটি মোবাইল ফোনের ফ্ল্যাক্সিলোডের দোকান দিয়ে সংসার চালাতেন। স্বামী গুম হওয়ার পর আমার সংসারের টুকটাক খরচ দিতেন শ্বশুর। কিন্তু শ্বশুরের মৃত্যুর পর নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। ছেলেটা গত বছর এইচএসসি পাস করেছে। টাকার অভাবে তাকে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করতে পারিনি। বন্ধ করে দিতে হয়েছে তার পড়ালেখা। মেয়েটা ক্লাস টুতে পড়ে। করোনার কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় খরচ কম। তবে সামনে স্কুল খুললে তার খরচ চালানো নিয়ে চিন্তায় আছি। তিনি বলেন, স্কুলের বান্ধবীদের দেখে মেয়ে অনেক কিছু দেয়ার বায়না ধরে। বড় করে নিজের জন্মদিন পালন করতে চায়। কিন্তু আমি দিতে পারি না। আমি কোথায় পাবো টাকা। এছাড়া সংসারের খরচ জোগানোর জন্য এখন মানুষের অনুদানই ভরসা। তিনি জানান, সোহেল গুম হওয়ার পর বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ডেকে নিয়ে দু’বার অনুদান দিয়েছেন। এছাড়া বছরের দু’টি ঈদে কিছু উপহার ও আর্থিক অনুদান পাঠান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এছাড়া সারা বছর কষ্ট করে সংসার চালাতে হচ্ছে।
এদিকে গত বছরের ৩০শে আগস্ট আন্তর্জাতিক গুম দিবসের একটি অনুষ্ঠানে বাবাকে ফিরিয়ে দেয়ার আকুতি জানিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে শিশু সাফা। তার আবেগমাখা কান্নার সেই ছবি ভাইরাল হয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সাংবাদিক এমরান হোসেনের তোলা সেই ছবিটি দৃকের প্রেস ফটো কনটেস্টে ফটো অব দ্য ইয়ার নির্বাচিত হয়।
শিশু সাফা বলে, বাবাকে গত আট বছর দেখি না। বাবার জন্য রাস্তায় রাস্তায় দাঁড়িয়েছি। আমি সরকারকে বলবো- বাবাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেন। আমার বিশ্বাস আমার বাবা একদিন ফিরে আসবে। আমার জন্য পুতুল নিয়ে আসবে।
সুত্রঃ মানবজমিন