নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজ’র ছাত্র রাহুল দেব রায়ের ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় উস্কানির নেপথ্যে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে সরিয়ে নতুন ব্যক্তিকে এই ক্ষমতায় বসানোর তৎপরতার আভাস মিলছে। এ ঘটনায় রাহুল দেবের বিচার দাবির থেকেও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ’র বিরূদ্ধে অপপ্রচারকে। কলেজের একটি সূত্র বিষয়টি জানায়। এদিকে রাহুল দেব রায়ের এই স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে এখনো এলাকায় উত্তেজনা বিরাজমান রয়েছে।
বুধবার (২৪জুন) এ বিষয়ে অনুসন্ধানে জানা গেছে, একটি চক্র ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ’র চেয়ার দখল করে ৫ জন কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে মোটা অংকের নিয়োগ বাণিজ্য করতে দীর্ঘ দিন ধরে তৎপরতা চালিয়ে আসছে। তারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য রাহুলের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে। এরপর ঠিক সময় মত মিথ্যা কাল্পনিক অপবাদ দিয়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের অপসারণ দাবি করে আন্দোলন শুরু করে। ইচ্ছাকৃতভাবে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের বিরুদ্ধে স্থানীয়দের ভুল বুঝিয়ে ঘটনার মোড় অন্যদিকে নিয়ে যায় তারা। মূলতঃ তাদের উদ্দেশ্য ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ’র পদ হতে স্বপন কুমার বিশ্বাসকে নামিয়ে দেওয়া। তবে নিয়োগ বাণিজ্যে তৎপর এই মহলটির বিষয়ে জানার পর স্থানীয়ভাবে অধিকাংশরা ধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্টের জন্য রাহুলের বিচার দাবি করেন।
সূত্রে জানা যায়, মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজ’র ছাত্র রাহুল দেব রায় শুক্রবার (১৭ জুন) ফেসবুকে ভারতের নুপুর শর্মা’র ছবি দিয়ে ‘প্রনাম নিও বস নুপুর শর্মা, জয় শ্রী রাম’ ক্যাপশন দেয়। শনিবার (১৮ জুন) সকালে তাকে কলেজে দেখে সাধারণ শিক্ষার্থীরা উত্তেজিত হয়ে পড়ে। কলেজের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) স্বপন কুমার বিশ্বাস তাৎক্ষণিক বিষয়টি উপস্থিত শিক্ষকদের জানান। এরপর মির্জাপুর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মুরসালিন, কলেজের জিবি’র সভাপতি অচিন চক্রবর্তী, পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায়, জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান, নড়াইল-১ আসনের সংসদ সদস্য কবিরুল হক মুক্তি সহ সংশ্লিষ্ট সকলকে জানান।
মির্জাপুর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মুরসালিন কলেজে গিয়ে রাহুলকে নিয়ে আসতে গেলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা মারমুখি হয়ে ওঠেন এবং বাধা দেন। কিছুক্ষণের মধ্যে নড়াইল সদর থানার ওসি শওকত কবির অতিরিক্ত ফোর্স নিয়ে সেখানে পৌঁছান। রাহুলকে উদ্ধারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এরপর নড়াইলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রিয়াজুল ইসলাম আরো পুলিশ নিয়ে মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজে যান। সাধারণ শিক্ষার্থী ও বহিরাগতদের বুঝিয়ে রাহুলকে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন। আস্তে আস্তে লোকজন বাড়তে থাকে। অনেকেই সম্পূর্ণ বিষয় না বুঝেই উত্তেজিত হয়ে যায়। আরো অতিরিক্ত পুলিশ নিয়ে পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায় সেখানে যান। রাহুলের উপযুক্ত বিচার দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে ওই এলাকার সাধারণ জনগণ ও শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে রাহুল রায়কে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন।
নড়াইলের পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায় পরিস্থিতি শান্ত করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় লোকজন যোগ দেয়ায় পুলিশের সাথে জনগণের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়। পুলিশ লাঠি চার্জ করে। এমনকি ৬ রাউন্ড টিয়ার সেল নিক্ষেপ করে। এ সময় কলেজ চত্বর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। কয়েকজন পুলিশ, কলেজ ছাত্র ও সাধারণ মানুষ আহত হন। মারাত্মক জখম হন কলেজের বাংলা বিষয়ের শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ। এ সময় একটি গোষ্ঠী কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন বিশ্বাস, শিক্ষক প্রশান্ত রায় ও শিক্ষক অরুন কুমার মন্ডলের মোটরসাইকেল ভাংচুর করে পুড়িয়ে দেয়। সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত তাণ্ডব চলে। বিকালে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান ঘটনাস্থলে যান। জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার দু’জন মিলে উপযুক্ত বিচার দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করে রাহুলকে থানায় নিয়ে আসেন।
এদিকে রোববার (১৯ জুন) সকালে নড়াইল-১ আসনের সংসদ সদস্য কবিরুল হক মুক্তি কলেজে গিয়ে শান্তি সভা করেন। সভায় কলেজের জিবি’র সভাপতি অচিন কুমার চক্রবর্তী অনাকাঙ্খিত ঘটনার জন্য দুঃখপ্রকাশ করে সকলকে শান্তিপূর্ণ সহবস্থানে থাকার অনুরোধ জানান। সেই সঙ্গে কলেজের শিক্ষকদের মোটরসাইকেল ভাংচুর করা ও পোড়ানো, শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করা ও মারপিটের ঘটনায় কোন মামলা করবেন না বলে জানান!
কবিরুল হক মুক্তি সকল শ্রেণি পেশার মানুষকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য অনুরোধ করেন। উপস্থিত সকলে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন। সে সময় সভায় উপস্থিত ছিলেন না ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস। পরবর্তীতে তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে মোবাইল বন্ধ পাওয়া গেছে।
এলাকার সচেতন মহল ধর্মীয় উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রচারের জন্য রাহুলের বিচার দাবি করার পাশাপাশি উস্কানি দিয়ে কলেজ এলাকায় নৈরাজ্য সৃষ্টিকারি এবং নাশকতার সঙ্গে জড়িতদের বিচার দাবি করেছেন।
উল্লেখ্য, ১৭ জুন রাহুলের ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে ১৮ জুন কলেজে উত্তেজনা ছড়িয়ে পরলে এক পর্যায়ে তা নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশের সহায়তা চান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার। কিন্তু এসময় তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু হয়, রাহুলকে রক্ষা করার জন্য পুলিশকে ডেকেছেন তিনি। এ ঘটনায় প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা গেছে, রাহুল এবং অধ্যক্ষ স্বপন কুমারের গলায় জুতার মালা পরিয়ে কলেজ ভবন থেকে বের করে নিয়ে আসে পুলিশ। ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে শুরু হয় সমালোচনার ঝড়। পুলিশের উপস্থিতিতে এ ধরনের মৌলবাদী কর্মকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ জানাতে দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এর পাশাপাশি সংসদ সদস্যের উপস্থিতিতে এ ঘটনায় উপস্থিত শিক্ষকদের কাছ থেকে দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে কোনও মামলা না করার জবানবন্দি আদায় করা হয়।
সুত্রঃ সময়ের আলো