ধর্ষণ মামলার আসামির সঙ্গে বাদীর বিয়ে কি সমাধান?
এক সপ্তাহের ব্যবধানে এই ধরনের তিনটি বিয়ে এবং জামিন পাওয়ার শর্ত হিসেবে আদালত আরও একজনকে বিয়ে করতে বলার পর প্রশ্ন উঠেছে, এভাবে কি ধর্ষণ সমস্যার সমাধান করা যাবে?
আইন বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, আদালত এই মামলাগুলোতে এভাবে হস্তক্ষেপ করে বিয়ে দিলে হিতে বিপরীত হতে পারে। বিয়ে করার জন্য ধর্ষণ বেড়ে যেতে পারে, আবার শাস্তি না হলেও একই ঘটনা ঘটতে পারে।
আদালতে এভাবে বিয়ে হলে স্ত্রীর সামাজিক মর্যাদা কতটা বজায় থাকবে, সংসারে ভালোবাসা আদৌ থাকবে কি না, এই বিষয়গুলোও বিবেচনায় আনার পরামর্শ এসেছে।
কেউ কেউ এমনও বলেছেন, মামলা থেকে বাঁচতে বিয়ে করে পরে স্ত্রীকে অবহেলা করবেন আসামি। চলতে পারে মানসিক নির্যাতন। আর ধর্ষণের কারণে মেয়েটির মনে যে ট্রমা বা মানসিক চাপ তৈরি হবে, তা থেকে সে বের হবে কীভাবে, সেটা বিবেচনা করা হচ্ছে না।
একজন নারী অধিকার কর্মী বলেছেন, কিছু ক্ষেত্রে বিয়ে হতে পারে। এতে এই বার্তা যাবে যে প্রলোভন দেখিয়ে সম্পর্ক গড়লে পার পাওয়া যাবে না।
গত ১৯ নভেম্বর নাটোরে একটি ধর্ষণ মামলার আসামির সঙ্গে বাদীর বিয়ে হয়েছে আদালতে। বিয়ের পর আসামি জামিন নিয়ে ঘরে ফিরেছেন।
একই দিন ফেনী কারাগারে বিয়ে হয় আরেক মামলার বাদী ও আসামির মধ্যে। আসামির বাবা বলেছেন, তার ছেলে মুক্ত হলে বিয়ের অনুষ্ঠান হবে। মেয়েপক্ষ বলেছে, ছেলেকে মুক্ত করতে ব্যবস্থা নেবে তারা।
২৪ নভেম্বর বিয়ে হয় কুমিল্লা আদালতে। মেয়েটি একজন প্রবাসীর স্ত্রী। তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি স্বামীকে পাঠানোর অভিযোগ ছেলেটির বিরুদ্ধে। এ কারণে মেয়েটিকে তালাক দেন তার স্বামী। পরে হয় ধর্ষণ মামলা। আদালত ভেবেছে সমাধান বিয়েতে।
আদালত থেকে সম্প্রতি এই ধরনের প্রথম নির্দেশনা এসেছে আরও আগে। জামিন চেয়ে এক আসামির আবেদনের পর গত ২২ অক্টোবর হাই কোর্ট বলেছে, বিয়ে করে এলে বিবেচনা করা হবে জামিনের।
মামলাটি প্রায় সাড়ে আট বছর আগের। ‘ধর্ষণের’ কারণে জন্ম নেয়া শিশুর পিতৃ পরিচয় দেয়ার চেষ্টা করেছে আদালত।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া মনে করেন, এভাবে বিয়ে সমাধান হতে পারে না। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।’
বিয়েতে কী সমস্যা?- জানতে চাইলে এই আইনজীবী বলেন, ‘এটার মাধ্যমে এক ধরনের উৎসাহ দেয়ার বিষয়টি চলে আসবে। মনে করেন, কোনো ছেলে একজন মেয়েকে পেতে চায়, তবে মেয়েটি তাকে চায় না। ছেলেটি ভাববে, ধর্ষণ করলেই তো হয়। পরে তো তার সঙ্গেই বিয়ে দেবে।’
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক মিজানুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যে অপরাধ করেছে সে অপরাধী। অবশ্যই তার বিচার হতে হবে। অপরাধীর সঙ্গে ভুক্তভোগীর বিয়ে দিয়ে কখনও এর সমাধান করা যায় না।’
এই আইন বিশেষজ্ঞ মনে করেন, বিয়েকে সমাধান ভাবলেও পরের ঘটনাপ্রবাহ কী হবে, তা নিয়ে চিন্তা করা হয়নি। তিনি বলেন, ‘যে বিয়ে করল, তার মানসিক অবস্থাটা কেমন হবে পরে? সে যে ট্রমার মধ্যে থাকবে সেটা কীভাবে দূর হবে?’
অধ্যাপক মিজান বলেন, ‘বাংলাদেশে সবকিছু আজগুবি নিয়মে চলে। এখানে বিজ্ঞান বা সমাজতত্ত্ব কোনো কিছুই খাটে না। যা হয়, সব ব্যক্তির ইচ্ছা অনুযায়ী হয়ে থাকে। কোনো একজন মনে করেছেন, এই ধরনের সমাধান দিলে হয়ত ঠিক হবে। কিন্তু এইগুলো যে আইনের চোখে ঠিক না এতটুকু বোঝার ক্ষমতা আমাদের নেই। এরাই এখন হর্তাকর্তা হয়ে দেশ চালাচ্ছেন।’
ধর্ষণ বরাবরই বাংলাদেশে এক আলোচিত বিষয়। নানা সময় এ নিয়ে আন্দোলনও হয়েছে। তারপরও পরিসংখ্যান উদ্বেগজনক।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে এক হাজার ৩৪৯ জন নারী ধর্ষণের অভিযোগ এনেছেন। যার মধ্যে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ ২৭৭টি।
প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ১৩০ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক)।
‘আমরাই পারি’ নামে আরেকটি সংগঠন জানাচ্ছে, এই সময়ে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ এনেছেন আরও ২০০ নারী, যৌন হয়রানির অভিযোগ এনেছেন ১৬১ জন।
ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪১ জনকে, আত্মহত্যা করেছেন ১০ জন। যৌন হয়রানির কারণে আত্মহত্যা করেছেন ১২ জন নারী।
নানা ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়েছে মানুষ। সম্প্রতি নোয়াখালীতে নারী নির্যাতনের এমন একটি ঘটনায় ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড করার দাবিতে টানা বিক্ষোভ হয়েছে। সরকার বিক্ষোভকারীদের দাবি মেনেও নিয়েছে।
আন্দোলনের পর ধর্ষণ মামলার বিচার দ্রুততর হয়েছে। বুধবার শরীয়তপুরে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও হত্যার দায়ে তিন জনের ফাঁসির আদেশ এসেছে। বেশ কয়েকজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে গত এক মাসে।
বিচারের জট যখন কাটছে, তখন আবার আসামির সঙ্গে বিয়ের প্রবণতা কেন- তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, আসকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক শিফা হাফিজ। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এটা (বিয়ে) তো আদালতের মাধ্যমে দেয়া হয়েছে। এখানে আমাদের আর কী বলার আছে? তেবে এটার অবশ্যই একটা বিরূপ প্রভাব পড়বে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা যখন ২০১৪ সালে বাল্য বিয়ের আইন নিয়ে কাজ করি, তখনও কয়েকজন বলেছিলেন ধর্ষণ হয়ে গেলে বিয়ে দিয়ে দেয়া উচিত। এখন কিন্তু আমরা সেটার প্রভাব দেখছি সমাজে। মেয়েদেরকে ইচ্ছা করেই উত্ত্যক্ত করা হচ্ছে। মনে হচ্ছে, এটা করলে তো বিয়ে দেবেই। আর এখন যদি এটা আদালতের মাধ্যমে হয়ে থাকে তবে সেটা একটা আশঙ্কার ব্যাপার।’
কী ধরনের আশঙ্কা করছেন শিফা হাফিজ?
তিনি বলেন, ‘একটা মেয়েকে আপনি সেই রেপিস্টের সঙ্গেই রেখে দিলেন। তার মানসিক অবস্থা কেমন হবে? সে কি কখনও যথাযাথ সম্মান পাবে? স্বামীকে ভালোবাসতে পারবে? এতে সংসারে সুখ আসবে?’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক জেবুন্নেসা কাজ করেন নারী অধিকার নিয়ে। তিনি মনে করেন, ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে এই ধরনের বিয়ে হতে পারে।
তিনি বলেন, প্রেমের সম্পর্ক থেকে শারীরিক সম্পর্কের পর বিয়ে না করার যে মামলা হয়, সেসব ক্ষেত্রে আদালত উদাহরণ তৈরি করে থাকতে পারে।
তিনি বলেন, ‘মানুষ সাবধান হতে পারবে। সবক্ষেত্রে যে বিরূপ প্রভাব পড়বে তা নয়। যে করবে, তখন সে ভাববে, আমি যদি এটা লুকিয়ে বা জোর করে থাকি, তাহলে পরবর্তীতে এমন কিছু হতে পারে। হয়ত রাষ্ট্র এটা করেছে যাতে এই অপরাধ প্রবণতা কমে যায়, আর মানুষ যাতে সচেতন হতে পারে।’
সুত্রঃ নিউজবাংলা