বাংলাদেশের একটি মফস্বল শহরে বড় হওয়া সাথী (পরিবর্তিত নাম) প্রথম যখন বুঝতে পারেন যে তার পছন্দ আশেপাশের অধিকাংশ নারীর মত নয় – অর্থাৎ তিনি পুরুষদের চেয়ে নারীদের প্রতি বেশি যৌন আকর্ষণ বোধ করেন – তখন তিনি তা নিয়ে বিস্মিত বা আতঙ্কিত হননি।
নারী হয়ে একজন নারীকে ভালো লাগা, নারীর সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়ানো বা নারীকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতে চাওয়ার বাসনা সাথীর দৃষ্টিতে সবসময় খুব স্বাভাবিক একটি বিষয়ই ছিল।
বিবিসি বাংলার সাথে কথা বলার সময় তিনি বলছিলেন, “নিজের ওরিয়েন্টেশন নিয়ে আমি কখনো কোনোরকম প্রশ্ন করিনি বা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগিনি, কারণ আমার সবসময় মনে হয়েছে যে – মানুষই তো, তাহলে যে কোনো মানুষকে তো ভালো লাগতেই পারে। এটার মধ্যে আবার অন্যরকম কী আছে?”
‘সমকামী বলে ইচ্ছা করে ইঙ্গিতপূর্ণ প্রশ্ন করা হয়’
সাথী বলছিলেন, পরিবারের সদস্যরা তার দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করবে না, এমন আশঙ্কায় পরিবারের কাছে নিজে থেকে কখনো নিজের পছন্দের কথা প্রকাশ করেননি তিনি। কিন্তু সমস্যা শুরু হয় যখন বন্ধুদের কাছ থেকে পরিবারের সদস্যরা তার পছন্দের বিষয়ে জানতে পারেন।
“বন্ধু মহল বা পরিবারের কাছাকাছি বয়সের সদস্যরা, যারা একসময় বুঝতে পেরে সমর্থন করেছিল, তারাই একসময় আমার ভবিষ্যৎ, সংসার, সুখের কথা চিন্তা করে আগ বাড়িয়ে আমার ব্যাপারে পরিবারের কাছে প্রকাশ করে দেয়। এবং আশঙ্কা অনুযায়ী পরিবার আরো বেশি চড়াও হয়ে পড়ে।”
সাথী বলছিলেন পরিবারের সদস্যরা জানার পর শুরুতে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে তার পছন্দ সুস্থ নয়। এক পর্যায়ে তারা তার মানসিক অসুস্থতার চিকিৎসা করানোর চেষ্টা করেন এবং বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকেন।
“মজার বিষয় হলো, সেসময় যারা আমার অবস্থা বোঝেন বলে দাবি করেছিলেন, তারাও সমলিঙ্গের প্রতি আমার আকর্ষণের বিষয়টিকে সাময়িক মোহ বলেই ধরে নিয়েছিলেন। তারা সেই সম্পর্ককে কোনো দামই দিতে চাননি। অর্থাৎ আমি যতক্ষণ কোনো ছেলের সাথে না যাচ্ছি, ততক্ষণ এ ধরণের সম্পর্ক সাময়িক।”
বন্ধুবান্ধব ও কাছের মানুষের কাছ থেকে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পাওয়ার পর একটা সময় নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করেন সাথী।
“এর পরের ধাপে আমাকে এবং আমার সঙ্গীকে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা হয়।”
“নানাভাবে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে – নেশাগ্রস্ত, চরিত্রগত সমস্যা আছে, ব্যবহার ভালো না – এমন নানা অভিযোগ ছড়ানো হতে থাকে এবং এখনো সেই প্রচেষ্টা চলমান আছে।”
তাকে এবং তার সঙ্গীকে ঘিরে কুৎসা রটানোর বিষয়টি একটা পর্যায়ে তার জন্য মানসিক চাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এক পর্যায়ে তার পরিবারের সদস্যরা বাসায় নিয়ে তাকে আটকে রাখে এবং প্রথাগত নিয়ম অনুযায়ী বিয়ে করার জন্য চাপ দিতে থাকে। পরে বন্ধুদের সহায়তায় বাসা থেকে বের হয়ে আসেন তিনি।
তিনি বলছিলেন, পরিবারের পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রেও একই ধরণের হয়রানির শিকার হতে হয়েছে তাকে।
“সহকর্মীরা আমার ব্যাপারে জানার পর অনেকেরই আমার প্রতি আচরণ পরিবর্তন হয়ে যায়। আমার সঙ্গীর ব্যাপারে প্রশ্ন করার সময় অনেক সময় তারা ইচ্ছাকৃত ভাবে ইঙ্গিতপূর্ণ, আপত্তিকর প্রশ্ন করতো। আমি সমকামী হওয়ার কারণে বিব্রতকর প্রশ্ন করে আমাকে খোঁচা দেয়ার চেষ্টা করতো।”
তার মতে, মানুষের মধ্যে সমকামীদের নিয়ে যতটা আগ্রহ রয়েছে, সমকামীদের হেনস্থা বা বিব্রত করার প্রবণতা তার চেয়ে বেশি – যে কারণে এই ধরণের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে তাকে।
সাথী বিভিন্ন প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে তার পছন্দের মানুষের সাথে জীবনযাপন করছেন এখনো। কিন্তু বাংলাদেশে অধিকাংশ সমকামী নারীর গল্পটা কিন্তু এরকম নয়।
যেমন ইউরোপের একটি দেশে বসবাসরত বাংলাদেশি নাগরিক সানিহা (পরিবর্তিত নাম) বাধ্য হয়েছিলেন প্রথাগত রীতিতে একজন পুরুষকে বিয়ে করতে।
ঢাকার উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান সানিহা তার পছন্দের বিষয়ে বাবা-মাকে বোঝাতে পারেননি। তার অভিভাবকরা মনে করেছিলেন বিয়ের পর ‘এসব ঠিক হয়ে যাবে।’
সানিহা বলছিলেন, “আমার মা বারবার আমাকে বুঝিয়েছিলেন যে বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে। এটা সাময়িক। তখন আমার বয়স কম ছিল, আমিও দ্বিধায় পড়ে যাই। কিন্তু বিয়ে করে স্বামীর সাথে কখনোই স্বস্তি বোধ করিনি। এখন আমি এক সন্তানের মা, কিন্তু স্বামীর প্রতি কখনোই কোনো সহানুভূতি ছিল না, এখনও নেই।”
“সেসময় যে কারণে বাবা-মা বিয়ে দিয়েছিল – যে মানুষ জানলে কী বলবে, সমাজে মান-সম্মান চলে যাবে – বাবা-মায়েদের ঐ মনোভাবটা সম্মান করেই এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে ভাঙছি না আমি আর আমার স্বামী।”
সানিহার ধারণা, বাংলাদেশে এমন অনেক নারী রয়েছেন যারা তার মত পারিপার্শ্বিক চাপে পড়ে প্রথাগত নিয়ম মেনে বিয়ে করেছেন এবং তার মত ‘মিথ্যা’ জীবনযাপন করছেন।
সমকামী নারীদের ‘আরোপিত’ জীবনযাপন
বাংলাদেশের সমাজে পুরুষের যৌনতা প্রকাশ করার বিষয়টি যত সহজভাবে গ্রহণ করে, নারীদের ক্ষেত্রে সেই গ্রহণযোগ্যতা সমাজে নেই বলে নারীদের জন্য ট্যাবুটা আরো বেশি কাজ করে বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরিন, যিনি বাংলাদেশের মানুষের যৌনতা বিষয়ে একাধিক গবেষণা করেছেন।
মিজ নাসরিন বলছিলেন, “বাংলাদেশে প্রচুর নারী আছেন যারা সমকামী, কিন্তু পরিবারের চাপে তারা বিয়ে করতে বাধ্য হচ্ছেন এবং পুরোটা সময়ই এক ধরণের আরোপিত জীবনযাপন করছেন।”
তার মতে, বাংলাদেশের সমাজে পুরুষের জন্য যৌনতার বহিঃপ্রকাশটা অনেকটা ‘সহনীয়’ হলেও নারীর ক্ষেত্রে বিষয়টি সেরকম নয়।
“তার ওপর নারী যখন আমাদের দেখার অভ্যস্ততা বা বাইনারি চিন্তাধারার বাইরে গিয়ে সমকামিতার কথা বলে, আমাদের সমাজে সহনীয় ও চর্চিত যে বহিঃপ্রকাশ রয়েছে তার বাইরে গিয়ে যৌনতার কথা বলেন – তখন সেই বিষয়টি আরো মেনে নেয় না সমাজ।”
যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৭৩ সালে সমকামিতাকে মানসিক রোগের তালিকা থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছিলো।
যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৭৩ সালে সমকামিতাকে মানসিক রোগের তালিকা থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছিলো।
নিজের যৌনতা লুকিয়ে রাখতে রাখতে বা বাধ্য হয়ে আরোপিত জীবনযাপন করতে করতে এক সময় মানসিক সমস্যার সম্মুখীনও হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, বলছেন মিজ নাসরিন।
“বাংলাদেশের গ্রামে আমরা দেখেছি, সবাই হয়তো কোনো একজন নারীকে বলছে যে সে পাগল হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা যখন তার সাথে আলাদাভাবে কথা বলি, তখন হয়তো জানতে পারি যে সে হয়তো একটা মেয়েকে পছন্দ করে এবং সেটা স্বজনরা মেনে নিতে পারে না, তাই তাকে পাগল হিসেবে আখ্যা দেয়।”
“বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের বাস্তবতায় এই পরিস্থিতি যেহেতু কাঙ্খিত না এবং গ্রহণযোগ্য না, নারী নিজেই অনেক সময় মনে করে যে সে আসলেই পাগল হয়ে গেছে। কারণ নারী নিজে এটা নিজেকেই বোঝাতে পারে না যে তার ক্ষেত্রে কেন এটা ঘটছে”, বলছিলেন মিজ নাসরিন।
অধ্যাপক নাসরিন বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, বিভিন্ন খাতে কর্মরত নারীদের মধ্যে, শহরে-গ্রামে গৃহিণীদের মধ্যেসহ সব ক্ষেত্রেই সমকামী নারীদের উপস্থিতি পেয়েছেন তারা।
সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন বা ‘আরোপিত’ জীবনযাপন করছেন, এমন নারীর সংখ্যা কত তা জানার জন্য কোন জরিপ বা গবেষণা বাংলাদেশে কখনো পরিচালিত হয়নি। কাজেই বাংলাদেশে সমকামী নারীদের সংখ্যাটা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায় না।
বাংলাদেশের আইনে সমকামিতা অবৈধ হওয়ায় এবং ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এটি পাপ হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় নিরাপত্তার স্বার্থে সমকামীদের একটা বড় অংশ এই বিষয়টি গোপন রাখেন। ফলে বাংলাদেশে সমকামীদের সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না।
সুত্রঃ বিসিবি বাংলা