সৌদি আরবে একটি মসজিদে ইমামতি করতো যুবক আব্দুর রব। সেখানে থাকা অবস্থায় ভার্চুয়াল বিভিন্ন মাধ্যমে বিভিন্ন জিহাদি পোস্ট ও ভিডিও দেখে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয় সে। পরে অনলাইনে রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের একটি ভিডিও কমেন্টের সূত্রধরে পরিচয় হয় আরও কিছু তরুণের সঙ্গে। কয়েকজনকে নিয়ে নিজেই গড়ে তোলে একটি নেটওয়ার্ক। এক পর্যায়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সৌদি থেকে চলে আসে দেশে। বিমানবন্দর থেকে বাড়িতে না গিয়ে সরাসরি চলে যায় জঙ্গি ক্যাম্পে। অবশ্য কোনও অঘটন ঘটানোর আগেই ধরা পরে গেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে। রবিবার (১ জানুয়ারি) রাজধানীর সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল, চট্টগ্রাম ও টেকনাফ থেকে এই মতাদর্শের ছয় জনকে গ্রেফতার করেছে মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের (সিটিটিসি)।
সোমবার (২ জানুয়ারি) বেলা ১১টার দিকে রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (সিটিটিসি) মো. আসাদুজ্জামান।
সিটিটিসি বলছে, জঙ্গিদের এই গ্রুপটি আল-কায়েদার মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের সশস্ত্র জিহাদ করার পরিকল্পনা নিয়েই সংঘটিত হচ্ছিল। গ্রেফতাররা হলো- সৌদি ফেরত দলনেতা আব্দুর রব (২৮), সাকিব (২৩), শামীম হোসেন (১৮), নাদিম শেখ (১৯), আবছার (২০) ও সাইদ উদ্দিন (১৮)।
সিটিটিসি প্রধান বলেন, গ্রেফতারকৃত আব্দুর রব সমন্বয়ক হয়ে সবাইকে অনলাইনে একত্রিত করে ‘শরিয়াহভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন’, ‘জিহাদ’ প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলোচনা করতো। পরবর্তী সময়ে তাদের অনলাইনে বিদেশে অবস্থানরত এক বাংলাদেশি সহযোগীর সঙ্গে পরিচয় হয় এবং অডিও-ভিডিও কলে যোগাযোগ স্থাপন করে। বিদেশে অবস্থানরত ওই ব্যক্তি সবাইকে হিজরত করে জিহাদের জন্য উদ্বুদ্ধ করে। সেই সদস্য লিবিয়ায় অবস্থানরত আরেক বাংলাদেশি এবং টেকনাফের স্থানীয় একজনের সাথে সবার পরিচয় করিয়ে দেয়। সম্মিলিত আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয় আব্দুর রব, শামীম, সাকিব, নাদিম, সাইদসহ অন্য যারা হিজরতে রাজি তারা প্রথমে টেকনাফ গিয়ে তাদের স্থানীয় সহযোগীদের মাধ্যমে ট্রেনিং গ্রহণ করবে। পরবর্তী সময়ে তারা বাংলাদেশে ইসলামি শাসন কায়েমের জন্য জিহাদ করবে।
গতবছরে নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে সবাই নিজ নিজ ব্যবস্থাপনায় টেকনাফে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন বলে জানান অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, সিদ্ধান্ত অনুসারে গত ১৬ নভেম্বর সাকিব ও নাদিম টেকনাফ যায় এবং স্থানীয় সহযোগী ও গ্রেফতারকৃত আবছার তাদের টেকনাফে ভাড়া বাসায় থাকার ব্যবস্থা করে দেয়।
প্রথম দিকে আব্দুর রব ছুটি না পাওয়ায় যথাসময়ে দেশে আসতে পারেনি। সেসময় অন্যরা টেকনাফের বাসায় অবস্থান করে তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। গত ২২ নভেম্বর গ্রেফতারকৃত আব্দুর রব দেশে আসলে তার সহযোগী গ্রেফতার শামীম ঢাকা শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে রিসিভ করে। পূর্ব পরিকল্পনানুযায়ী তাদের অন্য সহযোগী ভাড়া করা বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে অবস্থান করে বিভিন্ন শলা-পরামর্শ করে। দুই দিন পর তারা সাকিবদের সঙ্গে মিলিত হয়ে তাদের অন্যান্য সহযোগীদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
সিটিটিসির দাবি, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতাররা জানায়— তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অনলাইন ভিত্তিক অ্যাপে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে দল গঠন করে। পরে স্থানীয় সহযোগীদের নিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে দেশে জঙ্গিবাদের জন্য টেকনাফে হিজরত করে অবস্থান করছিল।
তারা সংঘটিত হচ্ছিল, সশস্ত্র জিহাদের প্রস্তুতি নিচ্ছিল— এটা কি কোনও সাংগঠনিক ব্যক্তি ছাড়া সম্ভব? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে সিটিটিসি প্রধান বলেন, ‘এখনও তারা সাংগঠনিক কাঠামো দাঁড় করাতে পারেনি। এটা ছিল তাদের প্রথম প্রচেষ্টা। তারা নিজেদের মধ্যে সশস্ত্র জিহাদের আলোচনা করে, এভাবে হিজরত করছিল। এদের প্রথমেই তেমন সদস্য সংখ্যা থাকে না, এরা আস্তে আস্তে সদস্য সংখ্যা বাড়ায়। তারা টেকনাফ পাহাড়ি এলাকায় অবস্থান নেওয়ার পরিকল্পনা করে।’
জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার সঙ্গে গ্রেফতারদের কোনও যোগাযোগ আছে কিনা জানতে চাইলে সিটিটিসি প্রধান আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আল-কায়েদার সঙ্গে তাদের কোনও যোগাযোগ নেই। গ্রেফতার জঙ্গিরা আল-কায়েদার মতাদর্শ অনুসরণ করে। অনলাইনে বিভিন্ন ভিডিও কনটেন্ট দেখে তারা মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি।’
এই আব্দুর রব কে?
জঙ্গি সংশ্লিষ্টতায় গ্রেফতার আব্দুর রব একজন কোরআনে হাফেজ এবং কওমি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে। ২০১৯ সালে জুনে সৌদি-আরব যায়। সেখানে রব একটি মসজিদের ইমাম, পাশাপাশি সে সেখানে হেফজ শিক্ষা দিতো। সৌদিতে অবস্থানকালে সে অনলাইনে বিভিন্ন জিহাদি পোস্ট ও ভিডিও দেখে জিহাদের জন্য অনুপ্রাণিত হয়। অনলাইনে রোহিঙ্গা নির্যাতনের একটি ভিডিও কমেন্টের সূত্রধরে সাইদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। একইভাবে শামীম, সাকিব, নাদিমসহ ও আরও কয়েকজনের সঙ্গে পরিচয় হয়।
গ্রেফতারদের বিরুদ্ধে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একটি মামলা করা হয়েছে বলে জানান এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘তাদের রিমান্ডে এনে এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত তথ্য জানার চেষ্টা করা হবে।’
সুত্রঃ বাংলা ট্রিবিউন