দেড় মাস ধরে বিশেষ অভিযান চালানোর পরও ঢাকার সিএমএম আদালত থেকে পলাতক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে আটক করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তারা দেশেই আত্মগোপন করেছে নাকি সীমান্ত দিয়ে অন্য দেশে পালিয়ে গেছে—সে বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থার কাছে নিশ্চিত কোনো তথ্য নেই। পালিয়ে যাওয়া দুই জঙ্গি প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন ও ব্লগার অভিজিত রায় হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। এরা গ্রেফতার না হওয়া পর্যন্ত বিষয়টিকে উৎকণ্ঠার কারণ হিসেবে দেখছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
এরই মধ্যে এই দুই জঙ্গিকে পালিয়ে যেতে সহায়তা করার অভিযোগে ওমর ফারুক নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে বলে দাবি করেছে সিটিটিসি।
গত ২০ নভেম্বর রাজধানীর সিএমএম আদালত এলাকা থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ও মোজাম্মেল হোসেনকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় তাদের সহযোগীরা। ঘটনার পর সারা দেশে বিশেষ অভিযান নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ ঘটনায় ১৬ জনকে গ্রেফতার করে পৃথকভাবে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে সিটিটিসি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, আদালতে জঙ্গি ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েক জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। পলাতক জঙ্গিদের নজরদারিতে রাখার পাশাপাশি জঙ্গি ছিনতাইয়ে যারা জড়িত, তাদের অনেককে শনাক্ত করা হয়েছে। আশা করছি অতি দ্রুতই তাদেরকে গ্রেফতার করা সম্ভব হবে।
এদিকে, দুই জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনা তদন্ত করে সিটিটিসি সাবেক রেলমন্ত্রী প্রয়াত সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের সাবেক এপিএস ওমর ফারুক তালুকদার ও তার স্ত্রী তানজিলাকে গত ২০ ডিসেম্বর গ্রেফতার করে। ওমর ফারুক পালিয়ে যাওয়া জঙ্গি আবু সিদ্দিক সোহেলের বোন তানজিলাকে বিয়ে করেছেন। সিটিটিসি ঘটনার আগে-পরের প্রযুক্তিগত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখতে পায় যে ওমর ফারুক জঙ্গি আবু সিদ্দিক সোহেল ও মোজাম্মেল হোসেনের স্ত্রীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। দুর্নীতির মামলায় ২০১২ সালে ওমর ফারুক যখন কারাগারে ছিলেন, তখন তিনি জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন। কারাগারে আবু সিদ্দিকের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে। কারাগার থেকে বের হওয়ার পর ওমর ফারুক আবু সিদ্দিকের বোনকে বিয়ে করেন।
সিটিটিসির প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার আসাদুজ্জামান বলেন, পলাতক দুই জঙ্গিকে গ্রেফতারের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তাদের অবস্থান কোথায়—এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তাদের অবস্থানের বিষয়ে এখনো বলার মতো কোনো তথ্য নেই।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, আদালত প্রাঙ্গণ থেকে ছিনতাই হওয়া দুই জঙ্গিকে গ্রেফতারে র্যাবসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে। যারা আদালত প্রাঙ্গণ থেকে পালিয়েছে তাদের আগের অপরাধ কার্যক্রম, তাদের বিচরণ ও সিসিটিভি বিশ্লেষণসহ সার্বিক দিক মূল্যায়ন করা হচ্ছে।
পুলিশের সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক বলেন, এ ক্ষেত্রে চরম গাফিলতি হয়েছে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ও দুর্ধর্ষ জঙ্গিদের আদালতে আনা-নেওয়ার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা আছে। এই নীতিমালা অনুসরণ করার জন্য জুনিয়র অফিসারদের হাতে নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেওয়া যাবে না। সিনিয়র ও অভিজ্ঞ অফিসার দিয়ে আদালতে ঝুঁকিপূর্ণ আসামি আনা-নেওয়ার বিষয়টি মনিটরিং করলে জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটত না। সামনের দিনগুলোতে যে কোনো আসামির ক্ষেত্রেই নিরাপত্তা ঝুঁকিকে বিবেচনায় নিতে হবে। দুই জঙ্গিকে গ্রেফতারের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে তাদের গ্রেফতার করতে না পারলে নাশকতার আতঙ্ক থেকেই যাবে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ বলেন, জঙ্গিবাদ দমনে অনেকদিনের নিষ্ক্রিয়তার কারণে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে এক ধরণের আত্মতুষ্টির ভাব থেকে তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় গাফিলতি ঘটেছে। বন্দী বহন বা স্থানান্তর করার সময় পুলিশ সদর দপ্তরের বিশেষ নির্দেশিকা রয়েছে। আদালতে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে হাজির করার সময় সেই নির্দেশিকা অনুসরণ করা হয়নি-এতে কোনো সন্দেহ নেই। অনুসরণ না করার কারণে গাফিলতি তৈরি হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে এরকম গাফিলতির দুই একটি ঘটনা থাকবে। সেক্ষেত্রে এই গাফিলতি পুলিশ সদর দপ্তর থেকে তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারলে আগামী দিনে যারা জঙ্গি দমনে কাজ করবেন তারা সতর্ক থাকবেন।
সুত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক