মাসুকুর রহমান ওরফে ‘রনবীর’ ওরফে মাসুদ সরকারের ডাক বিভাগে চাকরি করতেন। এই চাকরির পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন স্থানে ডাকাতিও করতেন। এক পর্যায়ে ডাকাতি মামলায় গ্রেফতার হলে তাকে পাঠানো হয় কারাগারে। এ সময় কারাগারে থাকা জঙ্গিদের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়। কারাগারে থেকেই জেএমবির আদর্শে অনুপ্রাণিত হন মাসুকুর রহমান ওরফে ‘রনবীর’ ওরফে মাসুদ।
সেখান থেকে বের হয়ে বিভিন্ন সময়ে কারাগারে থাকা জেএমবি সদস্য ও তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। একটা সময় পরে নিজেই হয়ে যান নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র শুরা সদস্য ও সামরিক শাখার প্রধান।
সোমবার (২৩ জানুয়ারি) নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র শুরা সদস্য ও সামরিক শাখার প্রধান রনবীর ও তার সহযোগী বোমা বিশেষজ্ঞ বাশারকে কক্সবাজারের কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকা থেকে গ্রেফতার করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। পরে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য জানতে পারে র্যাব।
মঙ্গলবার (২৪ জানুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাব সদর দফতরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি বলেন, ‘গত ২৩ আগস্ট কুমিল্লা সদর এলাকা থেকে আট জন তরুণ নিখোঁজ হয়। তার দু’দিন পরে অর্থাৎ ২৫ আগস্ট নিখোঁজদের পরিবার কুমিল্লার কোতয়ালি থানায় সাধারণ ডায়েরি করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আট তরুণের মধ্যে পালিয়ে আসা নিলয়কে আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদ করে গোয়েন্দারা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পায়। এর পর নিলয়কে ডি-র্যাডিক্যালাইজেশন সেলের মাধ্যমে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।’
র্যাবের মিডিয়া উইংয়ের এই কর্মকর্তা জানান, ‘নিলয়ের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনা করে গত ৫ অক্টোবর কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ হওয়া রিফাতসহ নতুন জঙ্গি সংগঠনের সাত জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে দেশে একটি নতুন জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রম সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। যার নাম ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’।’
তিনি বলেন, ‘র্যাব ফোর্সেস গোয়েন্দা শাখা এবং র্যাবের বিভিন্ন ব্যাটালিয়ন ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ আট তরুণের মধ্যে চার জনসহ নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র ৩৮ জন বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা ও সক্রিয় সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়া ২০২১ সাল থেকে এই জঙ্গি সংগঠনকে সহায়তা প্রদান এবং সামরিক প্রশিক্ষণের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অপরাধে পাহাড়ী বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কেএনএফের ১৪ জন নেতা ও সদস্যকেও গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে র্যাবের গোয়েন্দা শাখা জানতে পারে, জামাতুল আনসারের আমির মো. আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ নামের এক ব্যক্তি। যার নেতৃত্বে উগ্রবাদী সংগঠনটি পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়াও উগ্রবাদী এই সংগঠনে ছয় জন শূরা সদস্য রয়েছে, যারা দাওয়াতি, সামরিক, অর্থ, মিডিয়া ও উপদেষ্টার দায়িত্বে রয়েছেন।’
কমান্ডার মঈন জানান, জামাতুল আনসারের শূরা সদস্য আবদুল্লাহ মাইমুন দাওয়াতি শাখার প্রধান, গ্রেফতার মাসুকুর রহমান রনবীর সামরিক শাখার প্রধান, ইতোপূর্বে গ্রেফতার মারুফ আহমেদ সামরিক শাখার দ্বিতীয় ব্যক্তি, মোশারফ হোসেন ওরফে রাকিব অর্থ ও গণমাধ্যম শাখার প্রধান, শামীম মাহফুজ প্রধান উপদেষ্টা ও প্রশিক্ষণের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক এবং ভোলার শায়েখ আলেম বিভাগের প্রধান হিসেবে সংগঠনটিতে দায়িত্ব পালন করছে।
তিনি জানান, এই নতুন জঙ্গি সংগঠনের ৫৫ জন সদস্যকে পাহাড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফের প্রধান নাথান বম, সামরিক কমান্ডার কথিত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ভাংচুং লিয়ান বম এবং অপর আরেক নেতা মিডিয়া শাখা প্রধান কথিত লে. কর্নেল লালজং মুই ওরফে মাওয়াইয়া এবং কথিত লে. কর্নেল লাল মুন ঠিয়াল ওরফে চির চির ময়-এর সরাসরি তত্ত্বাবধানে পার্বত্য চট্টগ্রামে আশ্রয় দিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, এ তথ্যের পর বিভিন্ন সরকারি সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় র্যাব নব্য জঙ্গি সংগঠনের পাহাড়ে প্রশিক্ষণরত জঙ্গি সদস্য এবং তাদের প্রশ্রয় প্রদানকারীদের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান ও নজরদারি চলমান রেখেছে।
র্যাব জানায়, গত ২৩ জানুয়ারি ভোর ৫টায় র্যাব সদর দফতরের গোয়েন্দা শাখা, র্যাব-২, র্যাব-৩ এবং র্যাব-১৫ এর যৌথ অভিযানে কক্সবাজারের কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পসংলগ্ন ইয়াহিয়া গার্ডেনের গহীন বনাঞ্চল এলাকা থেকে সংগঠনের শূরা সদস্য ও সামরিক শাখার প্রধান মাসুকুর রহমান রনবীর (৪৪) ও বোমা বিশেষজ্ঞ আবুল বাশার মৃধা ওরফে আলমকে (৪৪) গ্রেফতার করা হয়।
এ সময় উদ্ধার করা হয় একটি বিদেশি পিস্তল, তিনটি পিস্তলের ম্যাগাজিন, ১০ রাউন্ড পিস্তলের গুলি, একটি ব্লাঙ্ক কার্টিজ, দুটি একনলা বন্দুক, ১১টি ১২ বোরের কার্তুজ, ১টি খালি খোকা, ১০০ রাউন্ড ২২ বোরের গুলি, একটি মোবাইল, নগদ ২ লাখ ৫৭ হাজার ২৬০ টাকা এবং পার্বত্য অঞ্চলে সামরিক প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের গুরুত্বপূর্ণ ও চাঞ্চল্যকর ভিডিও কন্টেন্ট।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘গত বছরের ২০ অক্টোবর গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব সদর দফতরের গোয়েন্দা শাখা এবং র্যাব-৭ এর বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি থানা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে সমতল থেকে পাহাড়ে আত্মগোপনে থাকা সাত জঙ্গি এবং তাদের সহায়তাকারী তিন জন কেএনএফ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর দিন ২১ অক্টোবর গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে বিলাইছড়ি থানায় সন্ত্রাস দমন আইনে একটি মামলা করা হয়।’
তিনি বলেন, “গ্রেফতার সাত আসামির মধ্যে নব্য জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র সামরিক শাখার উপ-প্রধান সৈয়দ মারুফ আহমেদ মানিক ছিলেন।” তিনি আরও বলেন, ‘গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বিলাইছড়ি থানায় করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আদালতে পাঁচ জন আসামির রিমান্ড আবেদন করেন। আদালত সংগঠনটির সামরিক শাখার উপ-প্রধান সৈয়দ মারুফ আহমেদ ওরফে মানিকসহ পাঁচ আসামির ছয় দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।’
কমান্ডার মঈন জানান, সৈয়দ মারুফ আহমেদকে জিজ্ঞাসাবাদে সংগঠনটির সামরিক শাখার প্রধান মাসুকুর রহমান ওরফে রনবীর ওরফে মাসুদের বিভিন্ন কার্যক্রম এবং সম্ভাব্য অবস্থান সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করে। এরই ধারাবাহিকতায় র্যাব রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৭ এর এ ব্লক থেকে জঙ্গি সংগঠনটির সামরিক শাখার প্রধান মাসুকুর রহমান ওরফে রনবীর ওরফে মাসুদ এবং আইইডি বা বোমা বিশেষজ্ঞ মো. আবুল বাশার মৃধা ওরফে আলম গ্রেফতার করে।
গ্রেপ্তার মাসুকুর রহমান রনবীর সম্পর্কে কমান্ডার মঈন বলেন, ‘তিনি ২০০৭ সালের আগে পোস্ট অফিসে চাকরি করতেন। ডাকাতির এক মামলায় গ্রেফতারের পর কারাগারে থাকাকালে জঙ্গিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং জেএমবির আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়। জেল থেকে বের হওয়ার পর তিনি বিভিন্ন সময়ে কারাগারে থাকা জেএমবি সদস্য ও তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন। ২০১৭ সালে জামাতুল আনসারের শূরা সদস্য এবং অর্থ ও মিডিয়া শাখার প্রধান রাকিবের সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য হিসেবে জামাতুল আনসারে দেন।’
তিনি বলেন, ‘২০২১ সালের নভেম্বর মাসে সিলেট থেকে চার তরুণের নিখোঁজের ঘটনায় তিনি জড়িত ছিলেন। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ শেষে নিখোঁজ ওই চার তরুণকে সে সামরিক শাখায় নিযুক্ত করে। প্রায় এক বছর আগে রনবীর সংগঠনের সামরিক শাখা প্রধানের দায়িত্ব নেয়। তার সামরিক কার্যক্রমের দুটি শাখা ছিল, যার একটি পাহাড়ে এবং অপরটি সমতলে। সমতলে সামরিক শাখার কার্যক্রম তার নেতৃত্বে পরিচালিত হতো।’
তিনি আরও বলেন, ‘পাহাড়ে র্যাবের অভিযান শুরু হলে তিনি সিলেট, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আত্মগোপন করেন এবং কিছুদিন আগে আত্মগোপনের উদ্দেশে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকায় অবস্থান নেন।’
কমান্ডার মঈন জানান, গ্রেফতার আবুল বাশার মৃধা ওরফে আলম হাটহাজারীর একটি মাদরাসা থেকে পড়াশোনা শেষে মাদরাসায় শিক্ষকতা করতেন। তার সাংগঠনিক নাম আলম। নিখোঁজ ৫৫ জনের তালিকায় আবুল বাশারের নাম রয়েছে। তিনি দীর্ঘদিন নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হুজি’র সঙ্গে জড়িত ছিলেন। হুজি সংগঠনে থাকাকালীন সময়ে ঝালকাঠির নলসিটি এলাকায় সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমের জন্য দায়ের করা নাশকতার মামলায় ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন বছর কারাভোগ করেন। ২০১৬-১৭ সালের দিকে জামাতুল আনসারের আমির মাহমুদের মাধ্যমে জামাতুল আনসারে যোগ দেন।
পাহাড়ে প্রশিক্ষণের জন্য ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে গৃহত্যাগ করেন এবং ২ মাস সমতলের বিভিন্ন জায়গায় প্রশিক্ষণ নেন আবুল বাশার মৃধা। পরবর্তী সময়ে তিনি রনবীর ও রাকিবের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ নিতে পার্বত্য অঞ্চলে যান। বয়সে বড় হওয়ার কারণে পাহাড়ে প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত নীতি নির্ধারণী বৈঠকে যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন। পাহাড়ে র্যাবের অভিযান শুরু হলে তিনি ৫৫ জনের দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পাহাড় থকে পালিয়ে সিলেটে যান। তিনি সামরিক শাখার প্রধান রনবীরের সঙ্গে সিলেট, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করেন। কিছুদিন আগে তিনি রনবীরের সঙ্গে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকায় আত্মগোপন করেন।
কুকিচিনের প্রধান নাথান বমের বিষয়ে জানতে চাইলে মঈন বলেন, ‘সামরিক শাখার প্রধান রনবীর বলেছে সেপ্টেম্বরের পর থেকে নাথান বমের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই। এখন আমির বা অর্থ শাখার প্রধানকে আমরা গ্রেফতার করতে পারিনি। তাদের যদি খুঁজে পাই এ বিষয়ে জানতে পারব।’
সুত্রঃ সারাবাংলা