দিন যায়, দিন আসে। এভাবে এক এক করে ১১ বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে। একাধিকবার তদন্ত সংস্থা পরিবর্তন হয়েছে। ৯৫ বার পিছানো হয়ছে মামলার তদন্ত প্রতিবেদনও। কিন্তু সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের পর বলা হয়েছিল; ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই আসামি গ্রেফতার করা হবে।
জানা গেছে, ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ৫৮/এ/২ বাড়ির ৫ তলার এ-৪ ফ্ল্যাটে নৃশংসভাবে খুন হন সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারোয়ার ও মেহেরুন রুনি। খুনের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের আইনের আওতায় আনার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
পরের দিন রুনির ভাই নওশের আলী রোমান বাদী হয়ে শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন। প্রথমে মামলাটির তদন্ত করেন শেরেবাংলা নগর থানার একজন কর্মকর্তা। ১৬ ফেব্রুয়ারি মামলার তদন্ত ভার পড়ে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উত্তরের পুলিশ পরিদর্শক মো. রবিউল আলমের ওপর। তবে এর দুই মাস পর হাইকোর্টের আদেশে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় র্যাবকে। সেই থেকে ১১ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো মামলার দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি।
মামলার বাদী ও রুনির ভাই নওশের আলম রোমান বলেন, ১১ বছরেও কোনো অগ্রগতি নেই, আর কবে হবে। কোনো অগ্রগতি হবে না। আমরা আশা ছেড়ে দিয়েছি। শুধু এতটুকু বলতে পারি, তদন্ত কর্মকর্তা এ বিষয়ে কাজ করছেন না। আমাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করা বন্ধ করে দিয়েছে। অথচ প্রতিবছর তারা নিয়ম মাফিকভাবে বলে আসছেন, দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কিছুই নয়।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আদালতও যেখানে বার বার সময় দিচ্ছেন, সেখানে আমাদের আর কি বলার আছে! তবে, জট খোলার চেষ্টা না করলে জট খুলবে না, এটাই স্বাভাবিক।
এদিকে, সাগর-রুনি দম্পতি হত্যার বিচারের দাবিতে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের উদ্যোগে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে শুক্রবার সকালে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশ শেষে সাংবাদিকরা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ মিছিল করে।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে দেখা করেন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নেতৃবৃন্দ। এ সময় তারা এ হত্যা মামলার তদন্ত দ্রুত শেষ করে খুনিদের মুখোশ উন্মোচনের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে দাবি জানান। এছাড়াও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ডিআরইউ কার্যনির্বাহী কমিটির পক্ষ থেকে স্মারকলিপি দেন সংগঠনের সভাপতি মুরসালিন নোমানী ও সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান সোহেল।
এ সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উপস্থিত সাংবাদিক নেতাদের উদ্দেশে বলেন, সাগর-রুনি হত্যার বিচারের দাবিতে ডিআরইউ আমাকে স্মারকলিপি দিয়েছে। বিচার তো আমরা করতে পারব না, আমরা তদন্ত রিপোর্ট দিতে পারব। ডিআরইউর স্মারকলিপি আমি র্যাবের ডিজিকে এখনই পাঠিয়ে দিচ্ছি। তাড়াতাড়ি একটা কিছু যেন তারা জানান, সেই নির্দেশনা তাদের দেওয়া হবে।
এ ব্যাপারে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি মুরসালিন নোমানী বলেন, সাগর-রুনি হত্যার বিচার যে পাইনি তা নিয়ে সাংবাদিকদের মধ্যে ক্ষোভ আছে। এ বিচার না পাওয়া পর্যন্ত ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি বিচার দাবি জানিয়ে যাবে। বিচারের দাবিতে বৃহস্পতিবার দুপুরে সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের কাছে ডিআরইউ নেতৃবৃন্দ স্মারকলিপি দিয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত কোনো হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্তে নেমে তদন্ত কর্মকর্তা প্রথমে হত্যাকাণ্ডের পেছনের কারণ খোঁজেন। এরপর আসামি শনাক্তকরণের চেষ্টা করেন, কোনো ধরনের ক্লু পেতে জব্দকৃত আলামত পরীক্ষা ও হত্যাকাণ্ডের শিকার ব্যক্তির খোয়া যাওয়া মালামাল উদ্ধারের চেষ্টা করেন। এসব একটি মামলা তদন্তের প্রাথমিক পর্যায়ের কার্যক্রম, ১১ বছর তদন্তের পরও সাগর-রুনি হত্যা মামলা ঠিক এরূপ প্রাথমিক পর্যায়েই রয়েছে। এখনো আসামি শনাক্তকরণ, জব্দকৃত আলামত পরীক্ষা ও নিহতদের খোয়া যাওয়া ল্যাপটপ উদ্ধারের চেষ্টায় রয়েছে তদন্ত সংস্থা।
র্যাব মামলার তদন্তে নেমে গ্রেফতার ৮ আসামি, নিহত দুইজন এবং স্বজন মিলে ২১ জনের ডিএনএ নমুনা পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠায়। যুক্তরাষ্ট্রের পরীক্ষাগার থেকে ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) পরীক্ষার রিপোর্টগুলো হাতে পেয়েছে র্যাব। সে রিপোর্ট ও অপরাধচিত্রের প্রতিবেদন (ক্রাইম সিন রিপোর্ট) পর্যালোচনায় দুইজনের ডিএনএর পূর্ণাঙ্গ প্রোফাইল পাওয়া গেছে। তবে এসব পরীক্ষায় সন্দেহভাজন খুনি শনাক্ত হয়নি।
এই মামলায় গ্রেফতার ৮ জনের মধ্যে পাঁচজন- রফিকুল, বকুল, সাইদ, মিন্টু ও কামরুল হাসান ওরফে অরুণ মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক নারায়ণচন্দ্র রায় হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। গ্রেফতার দেখানো হয় পারিবারিক বন্ধু তানভীর এবং বাসার নিরাপত্তাকর্মী পলাশ রুদ্র পাল ও হুমায়ূন কবীর। এদের মধ্যে সবাই হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন।
হত্যা মামলার তদন্ত প্রসঙ্গে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, এই মামলাটি অত্যন্ত সংবেদনশীল মামলা। এই মামলা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে তদন্ত করছি। এর জন্য বিদেশে বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতা নিয়েছি। বিদেশে ডিএনএ টেস্টের সহযোগিতা নিয়েছি। এখন পর্যন্ত তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করছি। তদন্তে একজন নিরাপরাধ ব্যক্তি যেন দোষী না হয়। প্রকৃত দোষীরা শনাক্ত করার জন্য একটু সময় লাগছে। আমাদের যিনি তদন্ত কর্মকর্তা তিনি অত্যন্ত সুষ্ঠভাবে তদন্তকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
সুত্রঃ ঢাকা মেইল