কওমি মাদ্রাসায় শিশু বলাৎকারের বিষয় নিয়ে অনেক আলোচনা হয় স্যোশাল মিডিয়ায়। বেশ কয়েক বছর যাবত এ নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা হচ্ছে। মূল ধারার মিডিয়াগুলোতেও পর্যাপ্ত সংবাদ পরিবেশন হয়েছে বিগত কয়েক বছরে। কয়েকদিন আগেই কামরাঙ্গীরচর একটি মাদ্রাসা ছাত্র বলাৎকারের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছে বলে সন্দেহ করা হয়েছে। বলাৎকারের শিকার হয়ে আত্মহত্যার ঘটনা এটাই প্রথম কি না জানি না। মাদ্রাসা মহলে এখন হয়ত সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়াস দেখা যাবে। তবে এই সচেতনতা আরো আগে থেকে হওয়া উচিত ছিল। কারণ একটা শিশু যখন বলাৎকারের শিকার হয় তখন সে আত্মহত্যা না করলেও তার মনের মৃত্যু ঘটে যায়। বিশেষত যখন তার উস্তাদ তার উপর পাশবিক নির্যাতন চালায় তখন তার অবস্থা কি হয় তা হয়তো ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
কোমলমতি শিশুদের মাদ্রাসায় পাঠানো হয় ধর্ম ও নৈতিকতা শিক্ষার উদ্দেশ্যে। তারা কোরআন হাদিস পড়ে নিজেরা ধর্মের উপর চলবে, অন্যদের ইসলামের পথে আহ্বান করবে। কিন্তু জীবনের শুরুতেই যদি সে তার শিক্ষকদের দ্বারা পৈশাচিক যৌন হয়রানির শিকার হয় তাহলে ধর্মের প্রতি তার শ্রদ্ধা স্বাভাবিকভাবেই নষ্ট হতে বাধ্য। সম্প্রতি বেশ কিছু ছেলেকে দেখা গেছে তারা তাদের শিক্ষকদের দ্বারা বলাৎকারের শিকার হয়ে পরবর্তী সময়ে নাস্তিক হয়ে গেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা বিষয়টি নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন। তাদের দুঃখের কথা তারা খোলামেলাভাবে তুলে ধরেছেন। কিছু বিকৃত রুচির শিক্ষক দিনের পর দিন কিভাবে সন্তান তুল্য ছাত্রদের সাথে অপকর্ম করেছে তার বিবরণ গুগলে সার্চ দিয়ে খুব সহজেই বের করা যাবে।
শিক্ষকদের দ্বারা বলাৎকারের শিকার হওয়ার ঘটনা তো অহরহ ঘটছেই। এর বাইরে আরো দুঃখজনক হচ্ছে, অনেক শিশু তার সহপাঠীদের দ্বারাও নিগ্রহের শিকার হয়েছে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা উঠছে। মূলত মাদ্রাসাগুলোর আবাসন ব্যবস্থা মোটেও ভালো নয়। দশ হাত কামরার ভেতরে বিশজন ছাত্রকে ঘুমাতে হয়। যেখানে ক্লাস সেখানেই খাওয়া এবং সেখানেই ঘুম। এমন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে যেসব ছেলে অবস্থান করবে তাদের বিকারগ্রস্ত হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
এধরনের ছেলেদের দিয়ে ইসলামের সৌন্দর্য প্রচার কতটা কঠিন তা সহজেই অনুমেয়। দোষ মাদ্রাসার ছাত্রদের নয়, দায়িত্বশীল আলেমদেরই এসব অপরাধের দায় নিতে হবে। বেফাক ও হাইআতুল উলিয়ার নেতৃস্থানীয় আলেমদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে বহুবার। কিন্তু তারা এসব ঘটনাকে বিরল অঘটন বলে পার পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। মাদ্রাসার ভেতরের অব্যবস্থাপনা সম্পর্কে কথা বললেই সেটাকে ইসলাম বিরুদ্ধ বলে পাশ কাটানোর চেষ্টা করা হয়। মাদ্রাসার শিক্ষকদের ত্রুটি সংশোধন করতে গেলে ইসলামের শত্রু আখ্যা দেয়া কতটা ইসলামসম্মত তা দায়িত্বশীল আলেমদের ভেবে দেখা কর্তব্য। এসব ঘটনাকে সবসময় ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেন কর্তৃপক্ষ। অথচ গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টির সুরাহা করা উচিত। এধরনের ঘটনা থেকে শিক্ষার্থীদের রক্ষা করা জরুরি। তা না হলে এই ছেলেরাই একসময় জঙ্গি হয়ে উঠবে। ধর্মের নামে সব ধরনের অপকর্ম করে বেড়াবে।
বালক বয়সে এধরনের মন্দ অভিজ্ঞতা একটা ছেলের মনোদৈহিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। সৃষ্টিশীল মন মানস একেবারে নষ্ট হয়ে যায়। তবে সমস্যা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা না করে সমাধানের পথ বের করতে হবে। সমাধান বের করতে হলে সমস্যার মূল বুঝতে হবে।
অপরাধে অভিযুক্ত কথিত মাদ্রাসার শিক্ষকরা শিশু বলাৎকারকে কোনো সাওয়াবের কাজ মনে করে না। ইসলাম ধর্মে এটা কত বড় অপরাধ তা তারা বিলক্ষণ জানেন। সব জেনে বুঝেই তারা এই সব অপকর্ম করেন। এথেকে সহজেই বুঝতে পারা যায়, কেবল ধর্মের জ্ঞান থাকলেই ধর্মের উপর চলা যায় না। নৈতিক মানবিক মূল্যবোধ পারিপার্শ্বিক পরিবেশ পরিস্থিতি থেকে শিখে নিতে হয়। পনেরো ষোল বছর কেবল মাদ্রাসার চার দেয়ালের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকলেই কেউ খাঁটি মানুষ হতে পারে না। খেলাধুলা, ব্যয়াম, বিনোদন ও সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা প্রতিটি শিশুর স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য একান্ত আবশ্যক। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে নিরানন্দ এক ঘেয়ে কুরআন হাদিসের চর্চা কোরআনের শিক্ষাগুলো হৃদয়ে গেঁথে দিতে পারে না। ইসলামি জ্ঞান বিজ্ঞানের বিরাট ব্যাপ্তি রয়েছে। ইসলামের বিপুল শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতি রয়েছে। উন্মুক্ত পাঠ ও চর্চার মাধ্যমে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মনন বিকশিত করতে হবে। নেতৃস্থানীয় আলেমদের উচিত শিক্ষার্থীদের জন্য সেই সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া।
সুত্রঃ সময় নিউজ