পঞ্চগড়ের আহম্মদনগর এলাকায় পাকিস্তান আমলেই বসতি গড়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন। দিন দিন তাদের পরিধি বাড়ে। বর্তমানে এখানে তাদের প্রায় তিন হাজার পরিবার রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রিতির মধ্য দিয়েই বসবাস করে আসছিল সব ধর্মের মানুষ। ২০১৯ সালে তাদের বার্ষিক সালানা জলসা ঢাকার পরিবর্তে পঞ্চগড়ে করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকেই সংকটের শুরু।
তখন থেকেই সম্মিলিত খতমে নবুওয়ত সংরক্ষণ পরিষদসহ বিভিন্ন ইসলামী সংগঠন তাদের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগে। তারা আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণাসহ পঞ্চগড়ে তাদের কোন জলসা করতে দিতে নারাজ। ২০১৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বিক্ষুব্ধ মুসল্লিরা আহমদিয়াদের ঘরবাড়ি অগ্নিসংযোগ ও তাদের উপর হামলা চালায়। সে সময় পুলিশসহ দুই পক্ষের অন্তত অর্ধশত মানুষ আহত হয়।
ওই ঘটনায় থানায় ২০ টি মামলার অভিযোগ জমা দিলেও আহমদিয়াদের কোনো মামলা নেয়নি বলে অভিযোগ করেন নেতারা। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়ায় এবারো সংঘর্ষ, হামলা, অগ্নিসংযোগ ও হতাহতের মতো ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি করেন তারা।
স্থানীয়রা জানায়, এবার সালানা জলসার অনেক আগেই মাঠে নামে ধর্মীয় নেতারা। গত ১১ ফেব্রুয়ারি পঞ্চগড় উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে খতমে নবুওয়ত মহা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে দেশের বিভিন্ন স্থানের আলেম ওলামাসহ ইসলাম ধর্মীয় বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা অংশ নেয়। ওই সম্মেলনে কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণার দাবি জানানো হয়। তারপরও প্রশাসন ৩ থেকে ৫ মার্চ আহম্মনগর এলাকায় তাদের তিনদিনের জলসার অনুমতি দেয়।
গত বৃহস্পতিবার জলসা বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভে নামে ইসলামী বিভিন্ন সংগঠনের কর্মী সমর্থকরা। তারা পঞ্চগড় চৌরঙ্গী মোড়ে অবস্থান নিয়ে ঢাকা পঞ্চগড় মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকে। এক পর্যায়ে তাদের একটি অংশ করতোয়া নদী পেরিয়ে আহম্মদনগর এলাকায় গিয়ে আহমদিয়াদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে ভাঙচুর চালায়। ওই দিন তাদের কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন। কাউকে আটকও করা হয়নি।
পরদিন শুক্রবার জুমার নামাজের পর বিভিন্ন মসজিদ থেকে খন্ড খন্ড মিছিল বের করা হয়। পরে সম্মিলিত মিছিলটি করতোয়া সেতু পেরিয়ে আহম্মনগর অভিমুখে যেতে চাইলে বাধা দেয় পুলিশ। এ সময় পুলিশের সাথে সংঘর্ষ হয়। তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট পাটকেল ছোড়ে। জবাবে পুলিশ টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। পুলিশের সামনেই তারা ট্রাফিক পুলিশের অফিস জ্বালিয়ে দেয়। পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর ও পুলিশের উপর হামলা করে দফায় দফায়। পঞ্চগড় বাজারের বেশ কয়েকটি আহমদিয়াদের দোকানের মালামাল বের করে আগুনে পুড়ে দেয়া হয়। পুলিশ, বিজিবি ও র্যাব কাছাকাছি থাকলেও সর্বোচ্চ সহনশীলতা দেখিয়েছে তারা।
৯৮ তম সালানা জলসার আহ্বায়ক আহমদ তবশির চৌধুরী বলেন, পুলিশের সামনেই ধর্মীয় উগ্রবাদী একদল প্রশিক্ষিত তরুণ আমাদের উপর হামলা করেছে। আমাদের ১৬০ টি পরিবারের ঘরবাড়ি ভাঙচুর অগ্নিসংযোগ করেছে। আমাদের ৬০ থেকে ৭০ জন আহত হয়েছে। একজনকে তারা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। ৪০ থেকে ৫০ জনের তরুণ দল তিন ঘন্টা ধরে তান্ডব চালিয়েছে। আমরা পুলিশের কাছে তেমন সহযোগিতা পাইনি। এর আগে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঠিক এমনি একটি ঘটনা ঘটেছিল। আমরা থানায় মামলার অভিযোগ জমা দিলেও মামলা নেয় নি পুলিশ। তখন আমাদের সমঝোতা করতে বলা হয়। এভাবে তাদের বার বার ছাড় দেওয়ার কারণে একই ঘটনার বার বার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। এবার আমরা হত্যা মামলার অভিযোগ থানায় জমা দিয়েছি। আশা করি প্রশাসন আমাদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবেন।
পঞ্চগড় পুলিশ সুপার এসএম সিরাজুল হুদা বলেন, পঞ্চগড়ে আহমদিয়াদের জলসাকে কেন্দ্র করে যারা হামলা ভাঙচুর করেছে এবং যারা তাদের পেছনে ছিলো তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। এরই মধ্যে গুজব সৃষ্টিকারী, হামলা ও লুটপাটের সাথে জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এমনকি কাদিয়ানী তরুণ জাহিদ হত্যার সঙ্গে জড়িত দুইজনকে আমার গ্রেপ্তার করেছি। তারা আমাদের কাছে হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। আমরা ভিডিও ফুটেজ দেখে তাদের চিহ্নিত করেছি। এখনও পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছে ২৩ জন।
সুত্রঃ কালেরকন্ঠ