আবুল বশর। বয়স ৩৮। গ্রামের বাড়ি খাগড়াছড়ি জেলায়। থাকেন চট্টগ্রাম শহরে। পেশা ইমামতি। নেশা বিয়ে করে যৌতুক দাবি। দাবি না মেটালে স্ত্রীকে মারধর করে তাড়িয়ে দেওয়া। নারী নির্যাতন মামলায় একবার জেলে গেলে বাদীর (স্ত্রীর) সঙ্গে আপস করেন। জেল থেকে বের হয়ে আবার ফিরে যান পুরনো চেহারায়। এভাবেই চলছিল আবুল বশরের ধর্মীয় লেবাসে ভানুমতির খেল। কিন্তু এবার আর ধোপে ঠেকেনি তার কৌশল। আদালতের পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছে তার সব ফন্দি-ফিকির।
সানোয়ারা সাহিদা (৩৩) নামে এক স্ত্রীর যৌতুক নিরোধ আইনে করা মামলায় চট্টগ্রামের একটি আদালত আবুল বশরকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেন। গতকাল সোমবার চট্টগ্রামের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট চতুর্থ আদালতের বিচারক কাজী শরিফুল ইসলাম এ রায় দেন। একই রায়ে তাকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও দুই মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। দণ্ডিত আসামির বাবার নাম আবেদ আলী। গ্রামের বাড়ি খাগড়াছড়ি জেলার মানিকছড়ি উপজেলার গাড়িটানা যোগ্যাছোলা এলাকায়। বর্তমানে থাকেন ইপিজেড থানাধীন দক্ষিণ হালিশহর এলাকার সেইলস কলোনি এলাকায়।
আদালত সূত্র জানায়, ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে যৌতুক নিরোধ আইনের ৩ ধারায় আদালতে সিআর মামলা (৬০/২০২২) করেন তার স্ত্রী সানোয়ারা সাহিদা। সাহিদা চট্টগ্রাম নগরের ইপিজেড থানাধীন আকমল আলী রোডের তিনকোনা মসজিদসংলগ্ন হেমায়েত কন্ট্রাক্টরের বাড়ির বাসিন্দা। বাদীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাইফুর রহমান নওশাদ জানান, বাদীপক্ষে আদালতে তিনজন সাক্ষ্য দেন। আসামি আবুল বশরের পক্ষে দুজন সাফাই সাক্ষ্য দেন। উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণ ও সাক্ষীর ভিত্তিতে আবুল বশরকে সাজা দেন আদালত। বিয়ের নামে বার বার নারীর সাথে প্রতারণা, যৌতুক দাবি এবং নির্যাতনের বিষয়টি আদালতের পর্যবেক্ষণেও এসেছে।
সূত্রটি জানায়, ২০২২ সালের জানুয়ারিতে সাহিদার করা মামলাটি সরাসরি আমলে নেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট চতুর্থ আদালত। এরপর আবুল বশরের বিরুদ্ধে সমন জারি করেন আদালত। সমন পেয়ে আত্মসমর্পণ করলে তাকে জেলহাজত পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। কারগারে কিছুদিন থাকার পর সানোয়ারার সঙ্গে আর সংসার করবেন না এবং তার দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করবেন বলে অঙ্গীকারনামা করেন আবুল বশর। পরে সেটি আদালতে দাখিল করে জামিনে মুক্তি পান। কিন্তু জামিনে মুক্তি পেয়েই সানোয়ারার কাছে থেকে ফের দুই লাখ টাকা যৌতুক দাবি করেন বশর। টাকা না দেওয়ায় তাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেন। একপর্যায়ে দুই সন্তানসহ সানোয়ারাকে ঘর থেকে বের করে দেন।
বাদীর আইনজীবী জানান, ২০০৭ সালের ৩ জানুয়ারি ইসলামী শরিয়াহ মতে ৬০ হাজার টাকা দেনমোহরে সানোয়ারাকে বিয়ে করেন আবুল বশর। এ সময় যৌতুক হিসেবে আবুল বশরকে তিন লাখ টাকা দেন সানোয়ারার বাবা মো. সেকান্দর। তাদের সংসারে ১৪ বছর ও ১২ বছর বয়সী দুটি পুত্রসন্তান আছে। আবুল বশর বিভিন্ন মসজিদে ইমামতি করেন। ধর্মের লেবাসধারী হলেও মূলত তিনি বিয়ে পাগল এবং উন্মাদ। বিয়ের নামে নারীদের সঙ্গে প্রতারণা করা তার নেশা।
এই আইনজীবী আরও জানান, ২০০৭ সালে সাহিদাকে বিয়ে করার আগের বছর ২০০৬ সালে নিজের ভাবিকে বিয়ে করেন বশর। ওই নারীর নাম জাহানারা বেগম। ভাবিকে বিয়ে করার তথ্য সাহিদার কাছে গোপন করেন বশর। ২০১৮ সালে সালেহা নামে আরও এক নারীকে বিয়ে করেন বশর। এ বিয়েও সাহিদার কাছে গোপন রাখেন বশর। তথ্য গোপন করে একাধিক বিয়ে ও প্রতারণা করায় সাহিদার সাথে বিভিন্ন সময় বশরের কথাকাটাকাটি হয়। স্বামীর খারাপ নেশার প্রতিবাদ করলেই তার ওপর নেমে আসত অমানুষিক নির্যাতন।
এর আগে ২০১৯ পাঁচ লাখ টাকা যৌতুকের দাবি পূরণ না করায় সাহিদার ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালান বশর। সহ্য করতে না পেরে ২০১৯ সালের ১৯ জুলাই আবুল বশরের বিরুদ্ধে ইপিজেড থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা দায়ের করেন সাহিদা। এ মামলায় ২০১৯ সালের ১ অক্টোবর আবুল বশরকে গ্রেপ্তার করে ইপিজেড থানা পুলিশ। ৬ নভেম্বর সাহিদার সাথে বিষয়টির আপস করেন বশর। এতে উল্লেখ করা হয়- কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেলে ভবিষ্যতে আর কোনো দিন সাহিদাকে মারধর করবেন না, সন্তানদের ভোরণপোষণ দেবেন এবং সাহিদার অনুমতি ব্যতীত বিয়ে করা দুই নারীকে তালাক দেবেন। কিন্তু জেল থেকে জামিনে মুক্ত হয়ে পুনরায় সাহিদার ওপর নির্যাতন শুরু করেন বশর।
অ্যাডভোকেট সাইফুর রহমান নওশাদ বলেন, ‘কয়লা ধুলে ময়লা যায় না। বার বার অঙ্গীকার করে জেল থেকে বেরিয়ে সেই পুরনো চেহারায় ফিরে আসেন আবুল বশর। জামিনে বেরিয়ে স্ত্রীকে করেন নির্যাতন। একবার জেলে গেলে বের হওয়ার জন্য আকুতি করে আপস করেন। জেল থেকে বের হয়েই পাল্টে যান তিনি। বিষয়টি নজরে আসায় এবার তাকে ছাড় দেননি আদালত। উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে তাকে দুই বছরের সাজা দিয়েছেন আদালত।
সুত্রঃ দেশ রূপান্তর