‘আমার ছেলের সঙ্গে এক হুজুর নিয়মিত দেখা করতেন। তিনি ছেলেকে জিহাদের দাওয়াত দিতেন বলে ছেলে একদিন আমাকে বলেছিল। তখন গুরুত্ব দিইনি। পরে ছেলে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। এরপর অনেক খোঁজ করে জানতে পারি, ছেলে জঙ্গিদের ফাঁদে পড়েছে।’
কালের কণ্ঠ’র কাছে আক্ষেপ করে কথাগুলো বলছিলেন এক মা। সম্প্রতি বান্দরবানের থানচি উপজেলার দুর্গম পাহাড়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর অভিযানে গ্রেপ্তার ২০ জনের মধ্যে এই মায়ের ছেলেও আছেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার লাকসামে।
গ্রেপ্তার ওই ২০ জনের মধ্যে ১৭ জন নব্য জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়ার সদস্য। অন্য তিনজন পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সদস্য।
গ্রেপ্তার হওয়া অন্য ১৬ জনের পরিবারের সঙ্গেও কথা বলেছে কালের কণ্ঠ। তাঁদের অভিভাবকরাও বলেছেন, জঙ্গিদের দাওয়াতি ফাঁদে পড়ে তাঁদের সন্তানরা ঘর ছেড়েছেন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কর্মকর্তারাও বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে গ্রেপ্তার জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদে সারা দেশে তাঁদের দাওয়াতি কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির তথ্য পাওয়া গেছে।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) আইন ও গণমাধ্যম শাখার প্রধান কমান্ডার খন্দকার আল মঈন কালের কণ্ঠকে বলেন, জঙ্গিরা নানা বেশে সমাজে অবস্থান করে সাংগঠনিক কাজ করছেন। নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়া সদস্য সংগ্রহের আগে তরুণদের ধর্মের কথা বলে ফাঁদে ফেলছে। ওরা জননিরাপত্তা নস্যাতের চেষ্টা করছে।
গ্রেপ্তার ১৭ জনের মধ্যে কুমিল্লা ও পটুয়াখালীর চারজন করে, বরিশালের দুজন এবং বরগুনা, ঝালকাঠি, সিলেট, হবিগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহের একজন করে তরুণ রয়েছেন। এই ১৭ জনের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশির ভাগই দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। বেশির ভাগ মাদরাসায় পড়তেন বা পড়েছেন। কয়েকজন কলেজে পড়েছেন এবং একজন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, জঙ্গিরা সহজ-সরল শিক্ষার্থীসহ সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষকে দলে ভেড়াচ্ছেন। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে এই প্রক্রিয়ায় জঙ্গিরা সাংগঠনিকভাবে শক্তি সঞ্চয় করতে থাকবেন। একে সামাজিকভাবে প্রতিরোধ করতে হলে সরলমনা, ধর্মপ্রাণ অভিভাবকদের সচেতন করতে হবে।
গ্রেপ্তার জঙ্গিদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের বরাতে তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে চট্টগ্রাম, সিলেট, সাতক্ষীরা, রাজশাহীসহ ঢাকার আশপাশে ছদ্মবেশী জঙ্গিদের তৎপরতা বেশি। এসব এলাকায় জঙ্গিদের অনুসারীরা মসজিদ-মাদরাসার পাশাপাশি অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও ছদ্মবেশে রয়েছেন। তাঁরা শিক্ষার্থীদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করছেন। মসজিদে নামাজের দাওয়াত দিয়ে বৈঠক করছেন। মগজ ধোলাই করে সুযোগমতো তাঁদের ঘরছাড়া করছেন। অনলাইনেও জঙ্গিদের বেশ কিছু গ্রুপ সক্রিয় থেকে তরুণ শিক্ষার্থীদের ফাঁদে ফেলছে।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীগুলোর কাছে তথ্য রয়েছে, শুধু নতুন জঙ্গি সংগঠনই নয়, দীর্ঘদিন ধরে দেশে নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজিবি), আনসার আল ইসলাম ও জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) আলাদা দাওয়াতি টিম রয়েছে। সারা দেশে এসব জঙ্গি দলের দাওয়াতি টিমের শতাধিক সদস্য রয়েছেন।
কুমিল্লার চার তরুণ : বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর জঙ্গিবিরোধী অভিযানে গ্রেপ্তার একজন জুবায়ের আইমান (২৯)। তাঁর বাবা নেই। বাড়ি কুমিল্লার লাকসাম থানার চিকুনিয়া গ্রামে। বাবা ছিলেন কৃষক। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। ২০২২ সালের ৮ নভেম্বর তিনি ঘর ছেড়ে নিরুদ্দেশ হন। এই তথ্য জানিয়ে তাঁর মা বলেন, গ্রেপ্তারের পর টেলিভিশনে তিনি ছেলে জুবায়েরের ছবি দেখতে পান।
এই মা বলেন, “বাড়ির পাশে মসজিদ। মসজিদে এক হুজুরের সঙ্গে ছেলের পরিচয় হয়। তিনিই ছেলেকে তাবলিগের কথা বলে ঘরছাড়া করেন। নিখোঁজ থাকার অনেক দিন পর একদিন ফোন করে ছেলে আমাকে বলেছিল, ‘মা, আমি জঙ্গির ফাঁদে পড়েছি। আমাকে বাঁচাও।’ এরপর আর কখনো আমার ছেলের ফোন পাইনি।”
‘জানতে পারলে সর্বশক্তি দিয়ে ছেলেকে ফেরাতাম’ : জহিরুল ইসলাম ওরফে ওমরের (২৮) গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের কান্দালে। তাঁর বাবা কাঠমিস্ত্রি। তাঁরা দুই বোন ও এক ভাই। ২০২২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি নিখোঁজ হন।
জহিরুলের বাবা বলেন, ‘ছেলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ শেষ করে বেকার ছিল। চাকরি করে তাকে সংসারের দায়িত্ব নিতে বলেছি। এর মধ্যে সে ছোটখাটো চাকরি করেছে। বিয়ে করেছে। তার তিন বছরের একটি মেয়েও আছে। নিখোঁজ হওয়ার আগে ও একদিন বাড়ি এসেছিল। সে বলেছিল, কাপ্তাইয়ে পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পরীক্ষা দিয়েছে। চাকরি হয়ে যাবে তার।’ তিনি আরো বলেন, ‘এখন শুনছি যে ছেলে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে গ্রেপ্তার হয়েছে। ছেলের সঙ্গে এখনো দেখা হয়নি, তবে ছবি দেখে ছেলেকে শনাক্ত করেছি। কখনো যদি জানতাম যে ছেলে জঙ্গিদের ফাঁদে পড়েছে, তবে সর্বশক্তি দিয়ে তাকে ফেরাতাম।’
‘র্যাবকে ধন্যবাদ জানাই’ : আস সামী রহমান ওরফে সাদের (১৮) গল্পও একই রকম। বাসা কুমিল্লা সদরের নোয়াপাড়ায়। বাবার একমাত্র ছেলে তিনি। কুমিল্লা সরকারি কলেজের এই ছাত্রও কথিত হিজরতের নামে নিখোঁজ হন।
তাঁর বাবা বলেন, ‘কখনো বুঝতেই পারিনি যে ছেলে জঙ্গিদের ফাঁদে পড়েছে। যখন জানতে পারি তখন থেকে ছেলের সন্ধান পেতে সর্বত্র খোঁজ করি। ছেলের বয়স কম। তাকে কেউ ভুল বুঝিয়ে এই পথে নিয়েছে। ছেলের সঙ্গে আমি বান্দরবান কারাগারে দেখা করেছি। সাক্ষাতের সময় ছেলে আমাকে বলেছে, জঙ্গিরা তাকে ভুল বুঝিয়ে তাদের দলভুক্ত করে। পরে সে বুঝতে পারে। ছেলের জন্য দিনরাত কেঁদেছি। ছেলেকে উদ্ধার করায় র্যাবকে ধন্যবাদ জানাই।’
‘ছেলের সঙ্গে কাদের যোগাযোগ ছিল, তা জানতে পারিনি’ : কুমিল্লা সদরের পাহাড়পুরের সাখাওয়াত হোসাইন ওরফে আনিসুর রহমানের (২০) বাবা একজন কৃষক। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছোট। এই মাদরাসাছাত্র ২০২১ সালের ১৫ অক্টোবর থেকে নিখোঁজ ছিলেন।
তাঁর বৃদ্ধ বাবা বলেন, ‘ছেলের সঙ্গে কাদের যোগাযোগ ছিল, তা জানতে পারিনি। আমার ভালো ছেলেকে যারা এই পথে নিয়ে গেছে, তাদের শাস্তি হওয়া উচিত।’
পটুয়াখালীর চারজন : ‘কোন হুজুর তার মগজ ধোলাই করল, তা জানতে পারিনি’ : পলিটেকনিক্যাল কলেজে তৃতীয় বর্ষে পড়তেন আল আমিন ওরফে ফকির মোস্তফা (১৯)। তার গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালী সদর উপজেলার লাউকাঠিতে। বাবা সবজি বিক্রেতা। ২০২২ সালের ১৯ জুন নিখোঁজ হন তিনি। মাঝেমধ্যে ফোন করে ছোট বোনের সঙ্গে কথা বলতেন। হুজুররা তাঁকে জিহাদের কথা বলে সঙ্গে নিয়ে যান বলে তিনি জানান।
আল আমিনের বাবা বলেন, ‘ছেলে কিভাবে যে জঙ্গিবাদে জড়াল, কোন হুজুর তার মগজ ধোলাই করল, তা জানতে পারিনি। আমার পরিবারের কেউ কখনো এই পথে যায়নি।’
‘ভাই জঙ্গিদের ফাঁদে পড়েছিল’ : পটুয়াখালীর মহিপুরের ওবায়দুল্লাহ সাকিব শান্ত (২০) মাদরাসার ছাত্র ছিলেন। তাঁর বাবা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। ২০২২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর তিনি বাড়ি থেকে ঢাকায় আসার কথা বলে নিখোঁজ হন। তাঁর বড় ভাই বলেন, পত্রিকায় দেখে তাঁরা শান্ত সম্পর্কে জানতে পারেন। ভাই জঙ্গিদের ফাঁদে পড়েছিল বলে মনে করেন তিনি।
‘সবাই তাকে ভালো ছেলে হিসেবে জানত’ : গ্রেপ্তার জুয়েল মাহমুদের (২৭) গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার সুবিদখালী গ্রামে। বাবা গ্রামের বাজারে ব্যবসা করেন। ২০২২ সালের আগস্টে তিনি বাড়ি ছাড়েন। তাঁর ভাই কালের কণ্ঠকে বলেন, তিন ভাই-বোনের মধ্যে জুয়েল ছিলেন বড়। মাদরাসায় পড়তেন। হঠাৎ করেই তিনি বাড়ি ছেড়ে নিখোঁজ হন।
জুয়েলের বিষয়ে প্রতিবেশী আফজাল মিয়া বলেন, ‘এলাকায় সবাই তাকে ভালো ছেলে হিসেবে জানত। এখন শুনছি জঙ্গিদলের সদস্য।’
‘কখনো মনে হয়নি যে সে এই পথে যেতে পারে’ : গ্রেপ্তার মিরাজ সিকদারের (২৬) বাড়ি পটুয়াখালীর লাউকাঠিতে। তাঁর বাবা দফাদার। তিন ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছোট। ঢাকা কলেজ থেকে মাস্টার্স শেষ করে বেকার ছিলেন। পটুয়াখালী জেলা ছাত্রকল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ২০২২ সালের ১৭ আগস্ট গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকার কাকরাইল মসজিদের কথা বলে বের হয়ে তিনি নিখোঁজ হন।
মিরাজের বড় ভাই বলেন, ‘নিখোঁজ হওয়ার পর কখনো মনে হয়নি যে সে এই পথে যেতে পারে।’
বরিশাল : ছেলের শোকে বাবা মারা যান
গ্রেপ্তার তানজিদ ডাকুয়ার গ্রামের বাড়ি বরিশালের বাকেরগঞ্জে। তাঁর বাবা প্রেসে কাজ করতেন। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে তানজিদ ছিলেন ছোট। বরিশালে তাঁর স্কুল। ঢাকায় কলেজ। ডিগ্রিতে ভর্তি হয়ে নীলক্ষেতে ভাইদের সঙ্গে বইয়ের দোকানে যুক্ত হন। ২০২১ সালের ২৬ মার্চ হঠাৎ নিখোঁজ হন তিনি।
এই তথ্য জানিয়ে তানজিদের বড় ভাই বলেন, ‘আমার ভাই কিভাবে যে এই ফাঁদে পড়ল, তা জানি না। ভাইয়ের শোকে বাবা মারা গেছেন। মৃত্যুর আগে বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। নাওয়াখাওয়া বন্ধ হয়ে যায় তাঁর। মা-ও অসুস্থ। পরিবারের সবাই উদ্বিগ্ন ছিলাম তাকে নিয়ে। পোস্টারিং করেছি, পত্রিকায় ছবিসহ বিজ্ঞাপন দিয়েছি। মাইকিং করেছি। কিন্তু কোথাও পাইনি। এরপর পাহাড়ে র্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের ছবি পত্রিকায় দেখে আমার ভাইকে শনাক্ত করি। ছুটে যাই বান্দরবানে। কারাগারে গিয়ে ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে জানতে পারি তার নিখোঁজ হওয়ার কাহিনি।’
তানজিদ তাঁর ভাইকে বলেছেন, ‘হুজুর ধর্মের কথা বলে আমাকে দাওয়াত দিয়েছেন। যখন বুঝতে পেরেছি, তখন ওঁরা আমাকে পালালে হত্যা করবেন বলে হুমকি দেন। জীবনে কখনো ওঁদের হাত থেকে ফিরতে পারব, তা ভাবতে পারিনি। ভাই, আমি ভুল করেছি। এখন ভালো হতে চাই।’
‘জঙ্গিরা আমার ভাইয়ের মাথা নষ্ট করেছে’ : বরিশালের আরেক তরুণ আব্দুস সালামকে পরিবারের লোকেরা শনাক্ত করে গ্রেপ্তার হওয়ার পর। তাঁর বয়স ২৮ বছর। বাড়ি বরিশাল কোতোয়ালির চরবাড়িয়া। তাঁর বাবা রিকশাচালক। তিনি মাদরাসায় পড়তেন। তাঁরা দুই ভাই ও এক বোন। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে হিজরতের নামে বাড়ি ছাড়েন সালাম। তাঁর ভাই দাবি করেন, ‘আমার ভাই সালাম নম্রভদ্র। জঙ্গিরা তার মাথা নষ্ট করেছে।’
বরগুনা : ‘ছেলে চাকরি করে সংসারের হাল ধরবে, এমন আশায় ছিলাম’
গ্রেপ্তার আরেক তরুণের নাম সোহেল মোল্লাহ ওরফে সাইফুল্লাহ (২২)। তিনি মিরপুর কলেজে অনার্সের ছাত্র। তাঁর গ্রামের বাড়ি বরগুনা সদরে। পরিবারের সঙ্গে রাজধানীর মিরপুরে থাকেন। বাবা মিরপুর এলাকায় চা বিক্রি করেন।
ছেলে কিভাবে এই পথে জড়ালেন, জানতে চাইলে এই বাবা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ছেলে আমার লেখাপড়ায় ভালো। এ জন্য আমি বৃদ্ধ বয়সে চা বিক্রি করে তার লেখাপড়ার খরচ জোগাই। সময় পেলে ছেলেও আমাকে চায়ের দোকানে সহযোগিতা করত। ছেলে চাকরি করে সংসারের হাল ধরবে—এমন আশায় ছিলাম। সেই ছেলে কিভাবে এই সর্বনাশা পথে পা বাড়াল, তা আমি বুঝতে পারিনি।’
ঝালকাঠি : ছেলের আশা ছেড়েই দিয়েছেন বাবা
গ্রেপ্তার হাফেজ হাবিবুর রহমান ওরফে মুরার (২২) বাড়ি ঝালকাঠির নবগ্রাম ইউনিয়নের বাউকাঠি কালি আন্দার গ্রামে। তাঁর বাবা স্থানীয় একটি মসজিদের ইমাম। হাবিবুর বরিশালের নথুল্লাবাদের হোসাইনিয়া মাদরাসা থেকে হাফেজি পাস করেন। ছিলেন পাশের মসজিদের মুয়াজ্জিন। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন ছোট। ২০২১ সালের ২৫ মার্চ মাদরাসা থেকে নিখোঁজ হন তিনি।
হাবিবুরের বাবা বলেন, ‘তাকে হাসপাতাল, জেলখানাসহ বিভিন্ন স্থানে খুঁজেও পাইনি। তার আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। থানায় জিডি করিনি। তবে পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা বাড়িতে এসে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। সে আটক হয়েছে কি না, আমার জানা নেই।’
হবিগঞ্জ : ‘সমাজে মুখ দেখাতে পারছি না’
হবিগঞ্জের মাধবপুর থেকে ২০২২ সালের ১৫ নভেম্বর নিখোঁজ তাওয়াবুর রহমানের ভাই কালের কণ্ঠকে বলেন, “আমার ভাই এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়েছিল। নিখোঁজ হওয়ার তিন মাস পর একদিন ফোন করে আমাকে বলে, ‘একজন হুজুরের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। হুজুর আমাকে ভুল বুঝিয়ে জঙ্গিবাদে জড়ান।’ হুজুরের নাম জানতে চাইলে অন্য প্রান্ত থেকে ফোন কেটে দেয়। এরপর আর কখনো ওর ফোন খোলা পাইনি। সম্প্রতি র্যাব পাহাড় থেকে যে ২০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে, এর মধ্যে তাওয়াবুরও আছে।”
তাওয়াবুরের ভাই বলেন, ‘আমার ভাইকে জঙ্গিদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য র্যাবকে ধন্যবাদ জানাই। তবে ভাই জঙ্গিবাদে জড়ানোর কারণে পুরো পরিবারের কেউ সমাজে মুখ দেখাতে পারছি না। আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে কেউ এই ভুল কখনো করেনি।’
তাওয়াবুরের ভাই আরো বলেন, ‘ভাই যত দিন নিখোঁজ ছিল, তত দিন আমার মা অসুস্থ ছিলেন। তার বেঁচে থাকার খবরে মা এখন অনেকটা সুস্থ।’
মুন্সীগঞ্জ : ‘বাবা, আমি ভুল করেছি’
রিয়াজ শেখ ওরফে জায়েরের (২৪) গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ীতে। বাবা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। চার ভাই-বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। মিরপুরের একটি কলেজে অনার্সের ছাত্র ছিলেন। হিজরতের নামে গত ৭ আগস্ট নিখোঁজ হন তিনি।
জায়েরের বড় ভাই বলেন, “সে সহজ-সরল এবং কিছুটা ধর্মভীরু ছিল। নিখোঁজ হওয়ার আগের দিন সকালে মাকে বলেছিল, ‘এক জায়গায় যাব, দ্রুতই ফিরে আসব।’ তবে কোথায় যাবে, তা সে বলেনি। কয়েক দিন পর বাড়িতে বাবার মোবাইল ফোনে অপরিচিত নম্বর থেকে একটা ফোন এসেছিল। ফোন বাবার কাছে ছিল না। পরে ওই নম্বরে ফোন করে বন্ধ পাওয়া যায়। কখনো ওই ফোন খোলা পাওয়া যায়নি।”
পত্রিকায় ছবি দেখে পরিবার রিয়াজকে শনাক্ত করে। বাবা বান্দরবান কারাগারে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেছেন। এ সময় রিয়াজ তাঁর বাবাকে বলেছে, ‘বাবা, আমি ভুল করেছি। এখন ভালো হতে চাই।’
টাঙ্গাইল : বিদেশ থেকে আসার পর চুপচাপ থাকতেন ইলিয়াস
গ্রেপ্তার ইলিয়াস রহমান ওরফে তানজিল ওরফে সোহেলের (৩২) বাড়ি টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলার রামকৃষ্ণবাড়ী গ্রামে। তাঁর বাবা ব্যবসায়ী।
তানজিলের এক চাচা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তানজিল মালয়েশিয়ায় প্রায় পাঁচ বছর থেকে ২০১৬ সালে বাড়িতে আসে। এক বছর আগে ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে এক বন্ধুর বাসায় যাবে বলে বাড়ি থেকে বের হয়। এরপর আমরা অনেক খুঁজেও তাকে পাইনি। তার বাবা ছেলের শোকে গত ডিসেম্বর মাসে অনেক কষ্ট নিয়ে মারা গেছেন।’
তানজিল ২০০৮ সালে ধনবাড়ী সরকারি নওয়াব ইনস্টিটিউশনে পড়তেন। বিদ্যালয়টির শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তানজিল লম্বা ও কোঁকড়া চুলের, দেখতে স্মার্ট। তার ব্যবহার ভালো ছিল। সে এসএসসির প্রাক-নির্বাচনী পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়। পরে আর পরীক্ষা দেয়নি।’
প্রতিবেশী রুবেল ফকির বলেন, তানজিল বিদেশ থেকে আসার পর চুপচাপ থাকতেন।
ময়মনসিংহ : ‘আমার ভাইকে যারা জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে, তাদের শাস্তি চাই’
শামিম হোসেন ওরফে আবু হুরায়রা ওরফে রাফি (২২) বান্দরবান থেকে গ্রেপ্তার হন। তাঁর বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলপুর থানার ঘোমগাঁও গ্রামে। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। তাঁর বাবা কৃষক। তিনি গ্রামের মাদরাসায় পড়া অবস্থায় ২০২১ সালের ১০ নভেম্বর ‘হিজরতের নামে’ বাড়ি ত্যাগ করেন।
শামিমের বড় ভাই জানান, লেখাপড়ার খরচ নিয়ে শামিমের সঙ্গে তাঁর বাগবিতণ্ডা হয়। চার-পাঁচ হাজার টাকা। এটা জোগান দেওয়াও তাঁদের জন্য কষ্টকর। রাগ করে শামিম বলেন, ‘আচ্ছা, আমি আর টাকা চাইব না। সক্ষম হিসেবে যদি দাঁড়াতে পারি তখন আপনাদের কাছে আসব।’ এরপর আর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি তাঁর। তিনি বলেন, ‘এখন শুনছি, সে নাকি জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। এটা খুব অস্বস্তিকর ও দুঃখজনক।’
শামিমের বড় ভাই কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাবা কৃষিকাজ করে আমাদের সাধ্যমতো লেখাপড়া করান। আমার পরিবারের কেউ কখনো উগ্র কিছুতে জড়িত ছিল না। আমার সহজ-সরল ছোট ভাইকে কিভাবে ওরা জঙ্গিবাদে জড়াল? সংসারে অভাবের মধ্যেই টিউশনি করে আমার ভাই মাদরাসায় পড়ত। যারা আমার ভাইকে জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে, তাদের শাস্তি চাই।’
ছদ্মবেশী জঙ্গিদের বিষয়ে অপরাধ বিশ্লেষক ও মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, জঙ্গিরা কাউকে ফাঁদে ফেলার আগে ধর্মের দাওয়াত দিয়ে প্রথমে কাছে টানে। এরপর জঙ্গিবাদে জড়ায়। এদের বিষয়ে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে আরো সতর্ক হতে হবে।
সুত্রঃ দৈনিক কালেরকন্ঠ