নওগাঁ পৌরসভা ও চণ্ডীপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের অফিস সহায়ক সুলতানা জেসমিন র্যাব হেফাজতে অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন। র্যাব তাকে আটকের সময় তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা ছিল না। র্যাব সদস্যরা আটক করার ৩১ ঘণ্টা পর তাঁর বিরুদ্ধে রাজশাহীতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা করে। গত ২৩ মার্চ বিকেল ৫টা ১০ মিনিটে নগরীর রাজপাড়া থানায় এ মামলা করেন স্থানীয় সরকারের রাজশাহী বিভাগের পরিচালক মো. এনামুল হক।
এনামুলের নামে ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলে প্রতারণার অভিযোগে মামলাটি করা হয়। বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে গতকাল এনামুল হককে কয়েক দফা ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।
রাজপাড়া থানার পুলিশ পরিদর্শক রুহল আমিন বলেন, ‘মামলার এজাহারে এনামুল হক উল্লেখ করেছেন, ২২ মার্চ নওগাঁ যাওয়ার পথে র্যাবের একটি দলের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। তখন তিনি তাঁর ভুয়া ফেসবুক আইডির বিষয়ে র্যাবকে অবহিত করেন এবং জড়িত ব্যক্তিকে আইনের আওতায় আনার অনুরোধ জানান। তখন র্যাব তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় ওই ফেসবুক আইডির ব্যবহারকারী হিসেবে জেসমিনকে শনাক্ত করে। আটকের পর জেসমিন তা স্বীকারও করেছিলেন। ’
সুলতানা জেসমিনকে গত বুধবার সকাল ১০টার দিকে অফিসে যাওয়ার পথে র্যাব সদস্যরা একটি মাইক্রোবাসে তুলে নেন বলে অভিযোগ ওঠে। পরে গত শুক্রবার রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। জেসমিনের স্বজনদের অভিযোগ, নির্যাতনের ফলে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। র্যাবের পক্ষ থেকে নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।
রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফ্রেন্ডশিপ মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক কফিল উদ্দিন বলেন, ‘আঘাতজনিত কারণে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে ওই রোগী মারা গেছেন। এটি হাসপাতালের ডেথ সার্টিফিকেটে আছে, আমরাও সেটি পেয়েছি। এর বাইরে মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হতে একটি নমুনা ল্যাবে পাঠিয়েছি। সেটির প্রতিবেদন আসার পর বিষয়টি আরো নিশ্চিত হওয়া যাবে। ’
শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাত ছিল কি না জানতে চাইলে এই চিকিৎসক বলেন, ‘সুরতহাল রিপোর্ট একজন ম্যাজিস্ট্রেট করেছেন। তিনি ভালো বলতে পারবেন। আমরা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে এসব বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করব। ’
মামলার বাদী এনামুল ওএসডি ছিলেন
স্থানীয় সরকার রাজশাহী বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সুলতানা জেসমিনের বিরুদ্ধে মামলার বাদী এনামুল হক গত বছরের ৪ জানুয়ারি রাজশাহীর স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। এর আগে তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন। এর আগে তিনি ওএসডি হিসেবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত ছিলেন। সেখান থেকে ২০২০ সালের ২৬ আগস্ট তাঁকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে পদায়ন করা হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জে থাকা অবস্থায় তাঁর বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠে বলে স্থানীয় একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
মামলায় অভিযোগ
রাজপাড়া থানার পুলিশ পরিদর্শক রুহুল আমিন বলেন, ‘এনামুল হক মামলার এজাহারে বলেছেন, জেসমিন তাঁর নামে ফেসবুকে একটি ভুয়া আইডি খুলেছিলেন। সেই আইডি দিয়ে তিনি প্রতারণা করছিলেন। টাকা হাতিয়ে নিচ্ছিলেন। জেসমিনের নাম উল্লেখ করেই মামলাটি করা হয়। ’
পুলিশ পরিদর্শক রুহুল আমিন বলেন, ‘আটক করা হলেও আমরা আসামি পাইনি। র্যাব জেসমিনকে নিয়ে এসে হাসপাতালে রেখেছিল। তাই মামলায় আসামিকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়নি। তবে মামলাটির তদন্ত চলছে। তদন্তে ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত সেটি বের করা হবে। ’
র্যাবের বক্তব্য
র্যাব হেফাজতে নির্যাতনের কারণে জেসমিনের মৃত্যু হয়েছে বলে স্বজনরা যে অভিযোগ করেছেন তা অস্বীকার করে র্যাব-৫ রাজশাহীর কম্পানি কমান্ডার মেজর নাজমুস সাকিব বলেন, প্রতারণার অভিযোগে আটকের পরপরই জেসমিন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তখন তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। এরপর গত ২৪ মার্চ শুক্রবার রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান জেসমিন।
তিনি দাবি করেন, আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদের সময় পড়ে গিয়ে তিনি আঘাত পান। তাঁকে কোনো নির্যাতন করা হয়নি।
‘কিছুক্ষণের আশ্রয়’ খালি
নওগাঁর চকদেব জনকল্যাণ মহল্লার দেলোয়ার হোসেন দুলালের মালিকানাধীন বাসা ‘কিছুক্ষণের আশ্রয়’-এ ভাড়া থাকতেন সুলতানা জেসমিন। প্রতিদিনের মতো গত বুধবার অফিসের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন জেসমিন। তবে জীবন নিয়ে ‘কিছুক্ষণের আশ্রয়’-এ আর ফেরা হয়নি তাঁর।
গত শনিবার বাদ আসর নওগাঁ কেন্দ্রীয় কবরস্থানে জেসমিনের লাশ দাফন করা হয়। গতকাল দুপুরে জেসমিনের ভাড়া বাসায় গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। প্রতিবেশীরাও কোনো কথা বলতে চাননি।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, সকাল ৯টা অথবা সাড়ে ৯টার দিকে জেসমিন বাসা থেকে বেরিয়ে কিছুটা পথ এগিয়ে পিটিআই স্কুলের মোড়ে (নওজোয়ান মাঠের কোনায়) আলিফের চায়ের দোকানে কাছাকাছি পৌঁছলে সেখানে আগে থেকে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মাইক্রোবাসে তাঁকে উঠিয়ে নেন র্যাব সদস্যরা। সেখানে উপস্থিত লোকজন কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাইক্রোবাসটি দ্রুত স্থান ত্যাগ করে। এ ঘটনার খবর জেসমিনের মামা নওগাঁ পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর নাজমুল হক মন্টুকে তাঁর পরিচিত একজন মোবাইল ফোনের মাধ্যমে জানান। সুলতানা জেসমিনের আগের কর্মস্থল ছিল নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার ভীমপুর ও চেরাগপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসে। সেখান থেকে বদলি হয়ে ২০২২ সালের ১৮ জানুয়ারি নওগাঁ পৌরসভা ও চণ্ডীপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসে যোগ দেন।
জেসমিনের মামা নাজমুল হক মন্টুর সঙ্গে গতকাল সরাসরি কথা হয় শহরতলির একটি নির্জন এলাকায়। তিনি জানান, জেসমিনকে দাফন করার সময় সাদা পোশাকে র্যাবের লোকজনও ছিল। ঘটনার দিন জেসমিনের মোবাইল ফোন থেকে তাঁর ছেলে সাহেদ হোসেন সৈকতকে বলা হয়, তোমার মাকে নওগাঁ সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ খবর সৈকতের কাছ থেকে জানতে পেরে নাজমুল হক মন্টু দ্রুত হাসপাতালে যান। সেখানে ষষ্ঠ তলায় একটি ওয়ার্ডে জেসমিনকে দেখতে পান। তখন সেখানেও র্যাবের দুই নারী সদস্য দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁদের কাছে কারণ জিজ্ঞেস করলে তাঁরা তাঁদের অফিসারের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। কিন্তু সবাই সাদা পোশাকে থাকায় কে অফিসার তা চিনতে পারেননি মন্টু। এ অবস্থায় খবর দেওয়ার জন্য বাড়িতে চলে আসেন। এরপর জেসমিনের দুলাভাই আমিনুল হাসপাতালে গেলে র্যাব অসুস্থ জেসমিনের সঙ্গে আমিনুলকেও রাজশাহী নিয়ে চলে যায়।
নওগাঁ পৌরসভা ও চণ্ডীপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের সহকারী ভূমি কর্মকর্তা কাজী রফিউল আলম বলেন, ‘আমি এখানে বদলি হয়ে এসেছি প্রায় আট মাস আগে। সুলতানা জেসমিনের বিষয়ে কেউ কখনো কোনো অভিযোগ করেনি। তিনি যতক্ষণ অফিসে থাকতেন পুরো সময় কাজের মধ্যেই থাকতেন। ’
বিভিন্ন সংগঠনের ক্ষোভ ও উদ্বেগ
র্যাবের হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিভিন্ন সংগঠন। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ), আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ (এইচআরএফবি) এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক নারী জোট গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো পৃথক বিবৃতিতে ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করে ঘটনাটির নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানায়।
এমএসএফের বিবৃতিতে বলা হয়, র্যাব কর্তৃপক্ষ ঘটনার যে বর্ণনা দিয়েছে তা গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ সুলতানা জেসমিনের বিরুদ্ধে আর্থিক প্রতারণার ও তাঁর ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেনের যে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তোলা হয়েছে, সে ক্ষেত্রে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একজন নারীকে রাস্তা থেকে তুলে নিতে হবে কেন? এমএসএফ এ ধরনের ঘটনার সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করতে এবং জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর বাইরে থেকে বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত সংস্থা গঠন করা আবশ্যক বলে মনে করে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের বিবৃতিতে বলা হয়, নির্যাতনের কারণে অসুস্থ হয়ে জেসমিনের মৃত্যু হয়েছে বলে পরিবার দাবি করলেও র?্যাব তা অস্বীকার করেছে। তবে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের চিকিৎসক জানিয়েছেন, হাসপাতালে ভর্তির সময় জেসমিনের মাথার ডান পাশে আঘাত ছিল। ব্রেনের ভেতর রক্তক্ষরণ হয়েছে বলে সিটি স্ক্যান রিপোর্টে উঠে আসে।
আসক মনে করে, পরিবারের অভিযোগ অত্যন্ত গুরুতর। তাই দ্রুততার সঙ্গে নিরপেক্ষভাবে এ অভিযোগ খতিয়ে দেখে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা জরুরি।
হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানিয়ে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩-এর আওতায় এ ঘটনার যথাযথ তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করার দাবি করে।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক নারী জোটের আহ্বায়ক তানিয়া রব তাঁর বিবৃতিতে বলেছেন, ‘র্যাব-পুলিশের হেফাজতে সাধারণ মানুষের মৃত্যুর দায় রাষ্ট্র কোনো ক্রমেই এড়িয়ে যেতে পারে না। ’
সুত্রঃ নিউজস২৪.বিডি.টিভি