নওগাঁয় আটকের পর র্যাব হেফাজতে ভূমি অফিসের কর্মচারী সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে দুজন বিচারকসহ একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছে উচ্চ আদালত। কমিটিতে জেলা ও দায়রা জজ এবং মুখ্য বিচারিক হাকিম (চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট) পদমর্যাদার দুজন বিচারককে রাখতে বলা হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিবের প্রতি এ নির্দেশ দিয়ে হাইকোর্ট বলেছে, ঘটনার সার্বিক তদন্ত করে আগামী ৬০ দিনের মধ্যে আদালতে রাষ্ট্রপক্ষকে প্রতিবেদন দিতে হবে। জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনায় করা রিট আবেদনের ওপর শুনানি নিয়ে গতকাল বুধবার বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি মুহম্মদ মাহবুব-উল ইসলামের হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেয়।
কোনো মামলা কিংবা পরোয়ানা ছাড়া শুধু মৌখিক অভিযোগের ভিত্তিতে জেসমিনকে র্যাব সদস্যদের তুলে নিয়ে যাওয়া কেন আইনগত কর্র্তৃত্ববহির্ভূত হবে না রুলে তা জানতে চেয়েছে হাইকোর্ট। চার সপ্তাহের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, র্যাবের মহাপরিচালকসহ বিবাদীদের রুলের জবাব দিতে বলেছে আদালত। একই সঙ্গে আদেশে আদালত নওগাঁর ওই ঘটনার সময় দায়িত্বরত (জেসমিনকে আটক ও জিজ্ঞাসাবাদ) র্যাব সদস্যদের তদন্তকালীন সংস্থার সদর দপ্তরে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।
হাইকোর্টের গতকালের আদেশের সময় বলা হয়, ‘সংবিধান সর্বোচ্চ আইন। নাগরিকের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেয় সংবিধান। যেখানে নাগরিকের সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে। আর সংবিধানের অভিভাবক সুপ্রিম কোর্ট। যখন সেই মৌলিক অধিকার ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার লঙ্ঘন নিয়ে প্রশ্ন ওঠে তখন সুপ্রিম কোর্ট আদেশ ও প্রতিকার দিতে পারে।’
নওগাঁ সদর উপজেলার চন্ডীপুর ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ে অফিস সহকারী পদে চাকরি করতেন সুলতানা জেসমিন। র্যাবের ভাষ্য অনুযায়ী, স্থানীয় সরকারের রাজশাহী বিভাগের পরিচালক (যুগ্ম সচিব) এনামুল হকের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জেসমিনকে আটক করা হয়। প্রতারণার অভিযোগে গত ২২ মার্চ সকালে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে নওগাঁ শহরের মুক্তির মোড় থেকে আটক করে র্যাব। এরপর অসুস্থ হয়ে ২৪ মার্চ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান তিনি। তবে সুলতানা জেসমিনের স্বজনদের অভিযোগ, জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতনের কারণে মারা গেছেন তিনি। কিন্তু র্যাবের দাবি তাকে নির্যাতন করা হয়নি। ইতিমধ্যে ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে পুলিশের বিশেষায়িত এ ইউনিটটি। আর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে মৃত্যু হয় জেসমিনের।
তার মৃত্যুর ঘটনায় গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন হাইকোর্টের নজরে আনেন আইনজীবী মনোজ কুমার ভৌমিক। ২৮ মার্চ আদালত তাকে বিষয়টি রিট আবেদন আকারে জমা দিতে বলে। ওইদিন একটি উচ্চপর্যায়ের বিচারিক তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশনা চেয়ে রিট আবেদন করেন এ আইনজীবী। সেদিন শুনানিতে তিনটি প্রশ্নের উত্তর জানতে চায় হাইকোর্ট। সুলতানাকে আটকের সময় তার নামে কোনো মামলা ছিল কি না, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় তাকে আটক বা গ্রেপ্তারের এখতিয়ার র্যাবের আছে কি না এবং ২২ মার্চ সকালে সুলতানাকে উঠিয়ে নেওয়া এবং তার মৃত্যু পর্যন্ত আসলে কী ঘটেছিলÑ এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানির জন্য ৫ এপ্রিল (গতকাল) দিন নির্ধারণ করেছিল আদালত। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল বিষয়টি আবারও শুনানিতে আসে।
শুনানিতে আইনজীবী মনোজ ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরে বলেন, ২২ মার্চ সকালে জেসমিনকে উঠিয়ে নেওয়া হয়। ৩৬ ঘণ্টা পর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয় পরদিন। আর তিনি রামেকে (রাজশাহী মেডিকেল কলেজ) মারা যান ২৪ মার্চ। রামেকের পরিচালক বলেছেন, জেসমিনের ঘাড়ের পেছনে ইনজুরির মতো ছিল। ময়নাতদন্তে কপালে একটা দাগ পাওয়া গেছে।
এ আইনজীবী ফৌজদারি কার্যবিধির সংশ্লিষ্ট ধারা উল্লেখ করে বলেন, ‘পরোয়ানা ব্যতীত কাউকে আটক বা গ্রেপ্তারের ক্ষমতা শুধুই পুলিশের। র্যাব কাউকে আটক বা গ্রেপ্তার করতেই পারে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, তারা ফৌজদারি কার্যবিধির সংশ্লিষ্ট ধারাগুলো অনুসরণ করছে কি না। যেটি জেসমিনের ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কোথাও এ মামলায় কাউকে আটক কিংবা গ্রেপ্তারের এখতিয়ার র্যাবের নেই। এ ক্ষমতা তাদের দেওয়া হয়নি। তাই র্যাব কর্র্তৃক জেসমিনকে আটক ও জিজ্ঞাসাবাদের প্রক্রিয়াটি অবৈধ।’
শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘মেডিকেল কলেজ কিংবা হাসপাতালের পরিচালকরা কখনো সরাসরি রোগী দেখতে যান না। ইমার্জেন্সিতে যারা থাকেন তাদের দেওয়া তথ্যের মাধ্যমে তারা বলেন।’ এ সময় জেসমিনের ময়নাতদন্ত ও সুরতহাল প্রতিবেদনের তথ্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে তিনি (জেসমিন) মারা গেছেন। ইনজুরির কোনো চিহ্ন নেই। শুধু একটি কালশিটে দাগের কথা বলা হয়েছে। এখন পরিচালকের বরাত দিয়ে শুধু মৌখিকভাবে বক্তব্য গ্রহণযোগ্য হবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘র্যাব এভাবে গ্রেপ্তার করতে পারে কি না, তা এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য থাকতে হবে তো। র্যাব এ ঘটনার তদন্ত করছে। এ মামলায় (রিট মামলা) রুল ইস্যু করার মতো বিষয় বা পরিস্থিতি হয়নি।’ শুনানি শেষে আদালত আদেশ ও রুল দেয়।
আদেশ শেষে রাষ্ট্রের এ প্রধান আইন কর্মকর্তা তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আদালত পর্যবেক্ষণ দিয়ে বলেছেন যে, যেহেতু এফআইআরটা করা হয়েছে ২৩ তারিখে (২৩ মার্চ) কিন্তু র্যাব তাকে আটক করেছে ২২ মার্চ। এই যে আটক করা এটা কোনো অবৈধ হবে না এ মর্মে রুল দিয়েছে। একই সঙ্গে এ ঘটনার সার্বিক তদন্ত করতে একটি কমিটি গঠন এবং যারা ওইখানে ছিলেন (ঘটনার সময়) তদন্তকালে তারা যেন সেখানে না থাকেন।’ হাইকোর্টের এ আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করা হবে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন বলেন, ‘লিখিত আদেশ পাওয়ার পর কর্র্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত হবে।’
সুত্রঃ দেশরুপান্তর