সিলেট থেকে গ্রেপ্তার হওয়া নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার দাওয়াতি শাখার প্রধান আবদুল্লাহ মায়মুন ওরফে মুমিনের (৩৪) সঙ্গে জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের প্রধান ও বরখাস্ত হওয়া মেজর সৈয়দ জিয়াউল হকের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল বলে দাবি করেছে র্যাব।
আজ দুপুর ১২টার দিকে র্যাবের সিলেট সদর দপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সংস্থাটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। এর আগে আজ সকালে সিলেটের বিমানবন্দর বড়শালা এলাকার একটি বাড়ি থেকে আবদুল্লাহ মায়মুনসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
আবদুল্লাহ মায়মুন সম্পর্কে খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, আবদুল্লাহ মায়মুন আনসার আল ইসলামের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি সংগঠনটির সিলেট বিভাগীয় মসূল বা প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন। সংগঠনটির শীর্ষ নেতা চাকরিচ্যুত মেজর জিয়ার সঙ্গে আবদুল্লাহ মায়মুনের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। এমনকি জিয়া নিয়মিত আবদুল্লাহ মায়মুনের বাসায় যাতায়াত করতেন। ২০১৯ সালে মায়মুন বগুড়ায় সন্ত্রাসবিরোধী একটি মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাভোগও করেন। পরে ২০২০ সালের শেষের দিকে জামিনে মুক্তি পেয়েছিলেন। পরে জামিন বাতিল হলেও আবদুল্লাহ মায়মুন আত্মগোপনে চলে যান। মূলত আবদুল্লাহ মায়মুন জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সঙ্গে নতুন সংগঠনটির যোগাযোগ করিয়ে সেতুবন্ধন করে দিয়েছিলেন। আবদুল্লাহ মায়মুনের মাধ্যমেই নতুন সংগঠনকে ১৫ লাখ টাকা অনুদান দেয় আনসার আল ইসলাম।
আজ সকালে সিলেট থেকে গ্রেপ্তার অন্য তিন ব্যক্তি হলেন ফরিদপুরের চরভদ্রাসনের মো. আবু জাফর ওরফে জাফর ওরফে তাহান (৪০), চাঁদপুর মতলব উত্তরের মো. আক্তার কাজী ওরফে সাইদ ওরফে আইজল (৩৮) ও গোপালগঞ্জ মুকসেদপুরের সালাউদ্দিন রাজ্জাক মোল্লা (৩২)।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাব বলে, নতুন জঙ্গি সংগঠনটির গড়ে তোলার পেছনের কারণ হলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের তৎপরতায় পুরোনো সংগঠনগুলো কোণঠাসা হয়ে পড়া। সাঁড়াশি অভিযানে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিল পুরোনো জঙ্গি সংগঠনগুলো। জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ থেকে কয়েকজন বের হয়ে নতুন সংগঠনটি গড়ে তোলেন। সংগঠনের সদস্যদের বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আইনপ্রণেতাদের ওপর ক্ষুব্ধ ধারণা রয়েছে। সদস্য সংগ্রহ করে জঙ্গিরা সংগঠিত হয়ে চট্টগ্রামে পাহাড়ে আবাসিকভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন।
প্রশিক্ষণ ও অর্থ জোগান
নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার আমির হলেন আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ। তাঁর সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) প্রধান নাথাম বমের সুসম্পর্ক ছিল। এর সূত্র ধরে তাঁদের মধ্যে অর্থ বিনিময়ের চুক্তি হয়। চুক্তির অংশ হিসেবে শারক্বীয়ার জঙ্গিদের পাহাড়ে আশ্রয়, অস্ত্র-রসদ সরবরাহ ও সশস্ত্র প্রশিক্ষণ প্রদান করত কেএনএফ। সংগঠনটির সদস্যদের প্রশিক্ষণ এবং থাকার ব্যবস্থা করার জন্য কেএনএফকে মাসে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা দিত সংগঠনটি। সংগঠনটি ২০২১ সালে প্রশিক্ষণ শুরু করেছিল। এর আগে ২০১৮ থেকে ২০১৯ সাল থেকে তারা সদস্য সংগ্রহ করছিল। গ্রেপ্তার হওয়া দাওয়াতি শাখার প্রধান আবদুল্লাহ মায়মুন প্রবাসে থাকা বিভিন্ন ব্যক্তি, অন্যান্য সংগঠন এবং নিজ অর্থায়নে সংগঠনের জন্য প্রাথমিকভাবে ৫০ লাখ টাকা সংগ্রহ করেছে বলে প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছে র্যাব।
ভিডিও তৈরির প্রস্তুতি চলছিল
নতুন জঙ্গি সংগঠনটি নিজেদের অবস্থান জানান দিতে বিভিন্নভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তবে এরই মধ্যে গোয়েন্দা খবরের ভিত্তিতে র্যাবের অভিযানের খবর পেয়ে সংগঠনের সদস্যরা সতর্ক হয়ে পড়েছিলেন। তাঁদের অবস্থান জানান দিতে তাঁরা ভিডিও তৈরিসহ বিভিন্ন প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তবে অভিযানের কারণে তাঁরা সেটি সম্পন্ন করতে পারেননি। র্যাবের নিয়মিত অভিযানের ফলে সংগঠনটির আমিরের নির্দেশে জঙ্গিরা পাহাড় থেকে পালিয়ে সমতলের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে গিয়ে পুনরায় সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছিলেন।
অর্থের জোগানদাতাদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে
র্যাব জানায়, জঙ্গি সংগঠনে অর্থের জোগানদাতাদের মধ্যে অনেকে বুঝেশুনে অর্থ দিয়েছেন। আবার অনেকে না বুঝে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গঠনসহ নানা কাজের কথা শুনে আবদুল্লাহ মায়মুনের কাছে অর্থসহায়তা দিয়েছেন। দেশ-বিদেশ থেকে আবদুল্লাহ মায়মুন এসব অর্থ সংগ্রহ করতেন। এর মধ্যে আবদুল্লাহ মায়মুনের আত্মীয়, বন্ধুবান্ধবসহ অনেকেই আছেন।
এ বিষয়ে খন্দকার আল মঈন বলেন, অর্থ জোগানদাতাদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। তাঁদের ব্যাপারে বিস্তারিত খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। যাঁরা বুঝেশুনে অর্থের জোগান দিয়েছেন, তাঁদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গ্রেপ্তার চারজনের পরিচয়
আবদুল্লাহ মায়মুনের পরিবারের সদস্যরা সবাই যুক্তরাজ্যে আছেন। তাঁর স্ত্রী ও সন্তানও সেখানে থাকেন। তবে আবদুল্লাহ মায়মুন কখনো সেখানে জাননি বলে জানিয়েছে র্যাব। আবদুল্লাহ মায়মুন সিলেটের স্থানীয় একটি মাদ্রাসা থেকে দাখিল সম্পন্ন করেন। পরে তিনি অনলাইনে ফিলিস্তিন, মিয়ানমার, ইরাকসহ বিভিন্ন স্থানে মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের ভিডিও দেখে উগ্রবাদে আকৃষ্ট হন। ২০১৩ সালে স্থানীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে আনসার আল ইসলামে যোগ দেন। পরে তিনি সংগঠনটির সিলেট বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। ২০১৯ সালে কারাগারে যাওয়ার পর ২০১৯ সালে জামিনে মুক্তি পান। এরপর তিনি আত্মগোপনে চলে গিয়েছিলেন। ২০২১ সালে শুরা সদস্য রণবীর ও মানিকের মাধ্যমে শারক্বীয়ায় যোগ দিয়ে পাহাড়ে চলে যান। আনসার আল ইসলামের বিভাগীয় প্রধান হওয়ায় নতুন সংগঠনে শুরা সদস্য ও দাওয়াতি শাখার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পান।
আবু জাফর ২০০১ সালে সুন্দরবনে হুজির সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নেওয়া অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি জেএমবিতে যোগ দিয়েছিলেন। জেএমবিতে থাকাকালীন ২০০৫ সালে পুনরায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। পরে কারাগার থেকে বেরিয়ে ২০১৮ সালে আবু জাফর মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে চলে গিয়েছিলেন। সেখানে থাকা অবস্থায় আবু জাফর শারক্বীয়ায় যোগ দেন। দেশে ফিরে তিনি নতুন সংগঠনের ১২ জনের দলনেতা হিসেবে পাহাড়ে প্রশিক্ষণের জন্য তথাকথিত হিজরত করেন। পাহাড়ে বিভিন্ন অস্ত্র চালানোসহ বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তবে আবু জাফরের পরিবারের সদস্যরা জানতেন তিনি মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থান করছেন। আবু জাফরের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী একাধিক মামলা আছে।
আক্তার কাজীর বিরুদ্ধে ২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ছিনতাই ডাকাতিসহ ৮ থেকে ১০টি মামলা আছে। তাঁকে চাঁদপুর, সিলেট, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা একাধিকবার গ্রেপ্তার করেছে। ২০১৭ সালে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে আক্তার কাজী আনসার আল ইসলামে যোগ দেন। পরবর্তী সময়ে শারক্বীয়ায় যোগ দিয়ে তিনি পাহাড়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
সালাউদ্দিন রাজ্জাক শারক্বীয়ার অন্যতম সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ২০১৮ সালে তিনি সংগঠনটিতে যোগ দেন। ঢাকার মিরপুরে থাকাকালীন বিভিন্ন সময় তাঁর বাসায় সংগঠনের আমির ও শুরা সদস্যরা বৈঠক করতেন।
সুত্রঃ প্রথম আলো