পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলায় যৌন নির্যাতনের শিকার এক মাদরাসাছাত্রীকে সালিস বৈঠকে জুতা দিয়ে পেটানোর অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যের বিরুদ্ধে। গোখলাখলী ইউনিয়নের বাদুরা গ্রামে গত ১০ জুন রাতে প্রাইভেট পড়ে বাড়ি ফেরার পথে ছাত্রীটিকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়। পরের দিন সকালে সালিসে ছাত্রী এবং তার ভগ্নিপতিকে তাদের কোনো কথা না শুনেই জুতাপেটা করা হয়। তবে যৌন নির্যাতনে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এ ঘটনার পর থেকে ছাত্রীটি ভয়ে-লজ্জায় গতকাল সোমবার এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত মাদরাসায় যায়নি।
ছাত্রীটিকে ধর্ষণচেষ্টায় অভিযুক্তের নাম হানিফ প্যাদা (৪০)। তিনি বাদুরা গ্রামের মেনাজ প্যাদার ছেলে। জুতাপেটায় অভিযুক্ত মো. শহিদুল প্যাদা গোখলাখলী ইউপির ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার)।
এ ঘটনায় গতকাল শহিদুল প্যাদাকে কারণ দর্শানোর জন্য জেলার সংশ্লিষ্ট বিভাগে চিঠি পাঠিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। গলাচিপা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দিন আল হেলাল এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
সপ্তম শ্রেণির নির্যাতিতা ছাত্রী গতকাল কালের কণ্ঠকে বলে, ‘আমি এহন মাদরাসায় যামু ক্যামনে? আমারে মেম্বারে মিথ্যা অপবাদ দিয়া হগুলডির (সবার) সামনে জুতা দিয়া পিডাইছে। আমার এহন ডর করে।
রাস্তায় যদি মেম্বারে আবার আমারে মারে!’
ছাত্রীর বাবা জানান, এ ঘটনায় তিনি ১২ জুন পটুয়াখালী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছেন। এ বিষয়ে ২১ জুন শুনানির তারিখ রয়েছে।
নির্যাতিতা ছাত্রী, তার বাবা ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, ছাত্রীটি প্রতিদিনের মতো ১০ জুন সন্ধ্যায় বাড়ির পাশে প্রাইভেট পড়তে যায়। রাত ৮টার দিকে ফেরার পথে হানিফ প্যাদা তাকে একা পেয়ে মুখ চেপে ধরে রাস্তার পাশে ঝোপে নিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা করেন। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে ছাত্রীর মুখ থেকে হানিফের হাত সরে গেলে সে চিৎকার দেয়।
চিৎকার শুনে ছাত্রীর ভগ্নিপতি ও স্থানীয় সোহেল হাওলাদার ঘটনাস্থলে গিয়ে হানিফকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখতে পান। মোবাইল ফোনে হানিফের ভিডিও করেন। পরের দিন সকালে হানিফের কথামতো স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. শহিদুল প্যাদাসহ স্থানীয় লোকজন নিয়ে রাস্তার পাশে এক চায়ের দোকানে সালিস বৈঠক ডাকা হয়। সালিসে উপস্থিত ছিলেন শহিদুল প্যাদা, আওয়ামী লীগের কর্মী মো. হাসান ঢালী, নলুয়াবাগী সাংগঠনিক ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক মো. জাহাঙ্গীর ঢালী, নলুয়াবাগী সাংগঠনিক ইউনিয়নের যুবলীগের সভাপতি মো. আলমগীর ঘরামি এবং যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক মো. সোবাহান প্যাদা। সকাল ১১টায় ছাত্রী এবং তার ভগ্নিপতিকে সালিসে ডেকে আনা হয়। তাদের কোনো কথা না শুনেই শহিদুল তাঁর পা থেকে জুতা খুলে ছাত্রীর ভগ্নিপতিকে হাইজ্যাকের একটি অভিযোগ তুলে জুতাপেটা করেন। এরপর তিনি ছাত্রীটিকেও অশালীন ভাষায় গালাগাল করে জুতাপেটা করেন। তখন ছাত্রীর ভগ্নিপতি প্রতিবাদ করেন এবং অভিযুক্ত হানিফের ওই ভিডিও দেখান। শহিদুলসহ দু-তিনজন দেখার পরই শহিদুল ভিডিওটি তাঁর এক সহযোগীকে দিয়ে মুছে ফেলান। পরে তিনি সালিস স্থগিত করে ওই দিন বিকেলে সালিস বসানোর ঘোষণা দিয়ে চলে যান। এর আগে শহিদুল একটি সাদা কাগজে ছাত্রীর বাবা, ভগ্নিপতিসহ স্থানীয় পাঁচজনের স্বাক্ষর নেন।
ছাত্রীর মা বলেন, ‘আমার মাইয়ারে নির্যাতন করে উল্ডা (উল্টো) সালিসে মেম্বার টাহা খাইয়া আমার মাইয়ারেই জুতা দিয়া প্রকাশ্যে পিডাইছে। আমি এর বিচার কার কাছে দিমু? মেম্বারের উল্ডা সালিস করলে এলাকায় থাহন যাইবে না।’
তবে অভিযুক্ত হানিফ প্যাদা বলেন, ‘আমাকে মিথ্যা হয়রানি করা হচ্ছে। এ ঘটনা সত্য নয়।’
মেম্বার মো. শহিদুল প্যাদা মোবাইল ফোনে বলেন, ‘সব মিথ্যা। আমি এর কিছু জানি না।’
সালিসদার আলমগীর ঘরামি বলেন, ‘আমি সালিসে আসার আগেই মেম্বার একটু উত্তেজিত হয়ে ছাত্রীটির ভগ্নিপতি ও ছাত্রীটিকে বকাবকি করেছে। জুতাপেটা আমি দেখিনি।’ তবে শহিদুল জুতাপেটা করেছেন বলে স্বীকার করেন আরেক সালিসদার জাহাঙ্গীর ঢালী। মো. হাসান ঢালী সালিসে থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, তিনি কাউকে জুতাপেটা করতে দেখেননি।
সালিসদার মো. সোবাহান প্যাদা বলেন, ‘আমরা সত্য ঘটনা উদঘাটনের চেষ্টা করেছি। ওই দিন বিকেলে আবার বসার কথা থাকলেও হানিফ প্যাদা অসুস্থ থাকায় বসা হয়নি।’
গলাচিপা থানার ওসি শোনিত কুমার গায়েন বলেন, ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনালে একটি মামলা করা হয়েছে। ২১ জুন মামলার শুনানির তারিখ ধার্য রয়েছে বলে জানতে পেরেছি। তাই আদালতের নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছে থানা কর্তৃপক্ষ। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের পর্যবেক্ষণে রেখেছি।’
সুত্রঃ কালেরকন্ঠ