গত বছরের ২৩ আগস্ট কুমিল্লা থেকে একসঙ্গে নিখোঁজ হয় আট কলেজছাত্র। পরে র্যাবের গোয়েন্দা দল জানতে পারে কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ ৮ তরুণসহ আরও বেশ কয়েকজন দুর্গম পাহাড়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। এসব তরুণ একসঙ্গে করার জন্য গঠিত হয় নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’। এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা শামিন মাহফুজ ওরফে শামিন স্যার ওরফে মেন্ডিং মুরং।
নতুন জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত প্রায় ৮০ জনকে গ্রেফতার করে র্যাব ও পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগ সিটিটিসি। তবে অধরা ছিলেন এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা শামিন মাহফুজ। দীর্ঘদিন গোয়েন্দা নজরদারির পর অবশেষে মোস্ট ওয়ান্টেড আসামি শামিন মাহফুজকে গ্রেফতার করেছে সিটিটিসি। একই সঙ্গে তার স্ত্রীকেও গ্রেফতার করা হয়। এ সময় বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও বিস্ফোরক জব্দ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
শুক্রবার (২৩ জুন) রাতে রাজধানীর ডেমরা এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। সিটিটিসি প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান জাগো নিউজকে এ তথ্য জানান।
শামিনের সঙ্গে কেএনএফ প্রধানের সম্পর্ক গড়ে ওঠে যেভাবে
শামিন মাহফুজের সঙ্গে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী পার্বত্য এলাকাভিত্তিক বিচ্ছিন্নতাবাদী উগ্রবাদী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) প্রধান নাথান বমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। ভিন্ন বিভাগ হলেও নাথান বম ও শামিন মাহফুজ একই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। সেই সূত্র ধরে নাথান বমের সহযোগিতা নিয়ে পাহাড়ি এলাকায় আস্তানা গড়ে তোলেন শামিন।
নিখোঁজ তরুণদের পাহাড়ে নেওয়া হয় যেভাবে
দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে নিখোঁজ তরুণদের জঙ্গি প্রশিক্ষণ দিতে শামিন মাহফুজ নিয়ে যান পাহাড়ে। সেখানে কেএনএফের আশ্রয়ে তাদের ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ চলতে থাকে। মূলত অর্থের বিনিময়ে নতুন জঙ্গি সংঠনের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেয় কেএনএফ। তবে দেশের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নতুন জঙ্গি সংগঠনকে পৃষ্ঠপোষক, সশস্ত্র প্রশিক্ষণ, সরকারের উন্নয়নমূলক কাজে বাধা ও অপহরণ রুখতে র্যাবসহ একাধিক গোয়েন্দা বাহিনী ধারাবাহিক অভিযান চালায়। ফলে এখন অনেকটা ভঙ্গুর অবস্থায় নতুন জঙ্গি সংগঠন ও কেএনএফ।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া তাদের বাছাই করা তরুণদের ছোট ছোট গ্রুপে সিনিয়র সদস্যের হেফাজতে রাখে। যেসব বাড়িতে রাখা হয়, সেটাকে তারা আনসার হাউজ (সাহায্যকারীর বাড়ি) বলে। এরপর চরাঞ্চলে শারীরিক কসরতসহ প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পরে উত্তীর্ণদের প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয় বান্দরবানে কেএনএফের ক্যাম্পে। ক্যাম্পে এসব জঙ্গির প্রশিক্ষণ শুরু হয় গত বছরের শুরুতে। সেখানে একে-৪৭ রাইফেল, পিস্তল ও কাটা বন্দুক চালানো, বোমা (আইইডি) তৈরি এবং চোরাগোপ্তা হামলার (অ্যাম্বুশ) প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পাহাড়ে প্রশিক্ষণ, ভারী অস্ত্র সংগ্রহসহ জঙ্গি সংগঠনের মূল সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেন শামিন মাহফুজ।
উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন শামিন
ছাত্রজীবনে মেধাবী ছিলেন শামিন মাহফুজ। এসএসসি ও এইচএসসিতে বোর্ড স্ট্যান্ড করেছিলেন। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। উত্তীর্ণ হন প্রথম শ্রেণি পেয়ে। ২০০৩ সালে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হন। শিক্ষকতা করেন ২০১১ সাল পর্যন্ত। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী খুমি সম্প্রদায় নিয়ে পিএইচডি গবেষণায়ও নিযুক্ত হন। থাকা শুরু করেন পাহাড়ে। এসময় জড়িয়ে পড়েন জঙ্গি কার্যক্রমে। সংগ্রহ করতে থাকেন সদস্য। এক পর্যায়ে নিজেই গড়ে তোলেন নতুন জঙ্গি সংগঠন। নাম দেন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’।
আগে দুইবার গ্রেফতার হন শামিন
জঙ্গিবাদে জড়ানোর কারণে এর আগে দুইবার গ্রেফতার হন শামিন। সবশেষ গ্রেফতার হন ২০১৪ সালে। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় ২০১৭ সালে জামিনে বের হওয়ার পর থেকেই ছিলেন লাপাত্তা। নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), আনসার আল ইসলাম, হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজিবি) থেকে সদস্য এনে নতুন জঙ্গি প্ল্যাটফর্ম তৈরিতে শামিনের ভূমিকা অগ্রগণ্য।
কারাগারে শামিনের সঙ্গে পরিচয় হয় শীর্ষ জঙ্গি নেতার
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জামাতুল আনসারের মূল সমন্বয়ক শামিন মাহফুজ ২০০৬ সালে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন। প্রথমে তিনি জামাতুল মুসলেমিনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। এরপর জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ- জেএমবির হয়ে কাজ করেন কিছুদিন। ২০১৪ সালে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে প্রায় তিন বছর কারাগারে ছিলেন। এ সময় তার সঙ্গে কারাবন্দি নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামি বাংলাদেশ- হুজিবির শীর্ষ নেতা মাওলানা আবু সাঈদের সঙ্গে পরিচয় হয়। মাওলানা আবু সাঈদ তাকে সব জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের একই মোর্চায় আনার পরামর্শ দেন। ২০১৮ সালে জামিনে বের হয়ে এসে সব জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের একটি সংগঠনের ছায়াতলে আনার বিষয়ে কাজ শুরু করেন শামিন।
পাহাড়ে কৃষি খামারের আড়ালে জঙ্গি আস্তানা করেন শামিন
২০১৮ সালে শামিন মাহফুজ আনসার আল ইসলামের এক শীর্ষ নেতা মাইনুল হাসান রক্সির সঙ্গে নতুন সংগঠন তৈরির জন্য কাজ শুরু করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা গাইবান্ধার বাসিন্দা শামিন মাহফুজ গবেষণার নামে পাহাড়ি এলাকায় গিয়ে জঙ্গি আস্তানা তৈরি করেন। ২০১১ সালেও বান্দরবানে জিহাদি বইপত্রসহ একবার তাকে গ্রেফতার করেছিল বিজিবি। সেসময় তিনি পাহাড়ে জমি বরাদ্দ নিয়ে কৃষি খামারের আড়ালে জঙ্গি আস্তানা তৈরি করেন। কিন্তু জামিনে বের হয়ে এসে তিনি আবারও নতুন উদ্যোমে জঙ্গিবাদী কার্যক্রম চালাতে থাকেন।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ২০১৮ সালে কারাগার থেকে বের হয়ে নতুন জঙ্গি সংগঠনের একটি সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি করেন শামিন। সেসময় নামহীন ওই সংগঠনের আমিরের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল মাইনুল হাসান রক্সিকে। ২০২১ সালের ৪ মার্চ কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অভিযানে সায়েদাবাদ থেকে মাইনুল ইসলাম ওরফে মাহিন ওরফে মিঠু ওরফে হাসান ওরফে রক্সিসহ সোহান সাদ ওরফে বারা আব্দুল্লাহ ও মুরাদ হোসেন কবীরকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তমাল ওরফে মাহমুদ ওরফে শওকত পান আমিরের দায়িত্ব।
কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা জানান, সেসময় গ্রেফতাররা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সুমন ওরফে ইব্রাহীম, শামিন মাহফুজ ওরফে প্রফেসর ওরফে স্যার, তমাল ওরফে বাপ্পি ও জনির নাম জানালে মামলায় তাদেরকেও আসামি করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতাররা আনসার আল ইসলামের সদস্য বলে স্বীকার করলেও নতুন সংগঠনের কথা স্বীকার করেননি। যদিও সেসময় নাইক্ষ্যংছড়িতে তাদের একটি আস্তানার কথা জানতে পারেন সিটিটিসি কর্মকর্তারা। তবে দুর্গম পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় সেখানে অভিযান চালাতে পারেনি। মূলত এরপরই শামিন মাহফুজ সংগঠনের নামকরণ করেন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া।
জানতে চাইলে সিটিটিসি প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার প্রতিষ্ঠাতা শামিন মাহফুজকে গ্রেফতারে গত কয়েক মাস ধরে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চলে। দীর্ঘদিন অভিযানের পর শুক্রবার রাজধানীর ডেমরা এলাকা থেকে সস্ত্রীক গ্রেফতার করা হয় তাকে। এ সময় বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও বিস্ফোরক জব্দ করা হয়েছে। শামিন মাহফুজ গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে নতুন জঙ্গি সংগঠন দুর্বল হয়ে পড়বে। তাকে রিমান্ডে নিয়ে জঙ্গি কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন, অস্ত্র সংগ্রহ ও নিখোঁজ তরুণদের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
সুত্রঃ জাগোনিউজ২৪.কম