জন্ম বাংলাদেশে। তবে জালিয়াতির মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন ভারতীয় পাসপোর্ট। দুই দেশেই জঙ্গি নেটওয়ার্ক তৈরিতে দিয়েছেন নেতৃত্ব। অতি গোপনে দীর্ঘদিন এমন তৎপরতা চালানোর পর বাংলাদেশের গোয়েন্দারা পাকড়াও করেছেন ইকরামুল হক নামে এই জঙ্গি নেতাকে।
৩০ বছর বয়সী ইকরামুলের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের কোতোয়ালিতে। তাঁর বাবার নাম জয়নাল আবেদীন ও মা ইয়াসমিন আক্তার। ২০০৮ সালে ঢাকার ফরিদাবাদ মাদ্রাসায় ভর্তি হন তিনি। ২০১৭ সালে ওই মাদ্রাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস শেষ করেন। এর পর ২০১৮ সালে ট্যুরিস্ট ভিসায় ভারতে যান। সেখানে তিনি বিখ্যাত দেওবন্দ মাদ্রাসায় ভর্তি হন। তবে ভারতে যাওয়ার আগে ফরিদাবাদ মাদ্রাসায় পড়াশোনার সময় আনসার আল ইসলামের আমির (সাবেক আনসারুল্লাহ বাংলা টিম) আবু ইমরান ওসমান গনির মাধ্যমে জঙ্গিবাদে জড়ান। এর পর ভারতে গিয়ে আল কায়দার আদর্শে অনেক তরুণকে গোপনে উদ্বুদ্ধ করেন।
এক পর্যায়ে পুরোপুরি জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত হয়ে আত্মগোপনে চলে যান। নূর হোসেন নামে ভারতীয় পাসপোর্ট তৈরি করেন ইকরামুল। সেখানে বাবার নাম দেন সাবু মিয়া ও মা নাবিয়া বিবি। ভারতীয় পাসপোর্টে তাঁর ঠিকানা– পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারের দিনহাটা এলাকা। এ ছাড়া ইকরামুল তাঁর বাংলাদেশি স্ত্রী ফারিয়া আফরিন অনিকার নাম-পরিচয় গোপন করে ভারতীয় আধার কার্ড তৈরি করেন। সেখানে অনিকার নাম দেওয়া হয়েছে মরিয়ম খাতুন ও বাবার নাম নান্নু মিয়া। নাম-পরিচয় গোপন করে এভাবেই আল কায়দার শীর্ষ নেতা হয়েছেন ইকরামুল।
তিনি আল কায়দার ভারতীয় উপমহাদেশের (একিউআইএস) উপপ্রধান। বর্তমানে তিনি সংগঠনটির দাওয়াতি বা দাওয়াহ শাখার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর বিরুদ্ধে ভারতে অন্তত ১০টি মামলা রয়েছে। ভারতের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তিনি অনেক দিন ধরেই মোস্ট ওয়ান্টেড জঙ্গি। বাংলাদেশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। সিটিটিসির প্রধান ডিআইজি মো. আসাদুজ্জামান সমকালকে বলেন, ইকরামুল আল কায়দাপন্থি শীর্ষ জঙ্গি নেতা। তাঁর নেটওয়ার্ক সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়ায় দুই দেশ বড় ধরনের আপাতত বড় ঝুঁকি এড়াতে পেরেছে। একই গ্রুপের আরও কয়েকজনকে আমরা খুঁজছি। জানা গেছে, ২৪ মে গুজরাট থেকে বাংলাদেশি চার তরুণকে গ্রেপ্তার করে ভারতের সন্ত্রাসবিরোধী স্কোয়াড (এটিএস)। তাঁরা হলেন– মোহাম্মদ সজীব, মুন্না খালেদ আনসারি, আহারুল ইসলাম ও মমিনুল আনসারি। গোয়েন্দাদের তাঁরা জানান, একিউআইএসের জন্য নতুন সদস্য নিয়োগ ও গোপনে সংগঠনের জন্য অর্থ সংগ্রহের কাজ করে আসছিলেন তাঁরা। তাঁরা স্বীকার করেন, ইকরামুল হক নামে বাংলাদেশি এক ব্যক্তির মাধ্যমে জঙ্গি সংগঠনে নাম লেখান। মাস সাতেক আগে স্ত্রীকে নিয়ে অবৈধ পথে ইকরামুল বাংলাদেশে ফেরত আসেন।
একাধিক সূত্র থেকে বাংলাদেশি গোয়েন্দারা ইকরামুলের ব্যাপারে তথ্য পাওয়ার পর নড়েচড়ে বসেন। সিটিটিসির ভাষ্য, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ৩০ মে রাজধানীর মাদারটেক এলাকায় অভিযান চালিয়ে ইকরামুল ও তাঁর স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করা হয়। জব্দ করা হয় তাঁর ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন। পরে কয়েক দফায় হেফাজতে এনে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জব্দ আলামতের ফরেনসিক পরীক্ষা করা হয়। আল কায়দার মতাদর্শী আরও কয়েক জঙ্গিকে গ্রেপ্তারের ফাঁদ ও ফরেনসিক পরীক্ষার প্রতিবেদন পেতে বিষয়টি শুরু থেকে গণমাধ্যমকে জানায়নি সিটিটিসি। তবে ইকরামুলের পরিবারের বক্তব্য, ৩০ এপ্রিল ময়মনসিংহ থেকে ইকরামুল ও তাঁর স্ত্রীকে আটক করা হয়। জঙ্গিদের কর্মকাণ্ডের ওপর এক যুগের বেশি নজর রাখা একজন কর্মকর্তা জানান, মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ নামে এক জঙ্গিকে ২০২১ সালে গ্রেপ্তার করেছিল বাংলাদেশ পুলিশ। এর পর খালিদ জানান, ভারতের দেওবন্দে ‘মাওলানা সাবেত’ নামে একজন শীর্ষ জঙ্গি রয়েছেন। তিনি একিউআইএসের দাওয়াতি শাখার প্রধান হিসেবে কাজ করছেন। সাবেতের সঙ্গে দেওবন্দে খালিদের দেখা হয়েছিল।
তবে ওই সময় সাবেতের আসল পরিচয় জানতে পারেননি বাংলাদেশি গোয়েন্দারা। গত মে মাসে গুজরাটে চার বাংলাদেশি জঙ্গি গ্রেপ্তারের পর সাবেতের পরিচয় বেরিয়ে আসে। এই সাবেতই হলেন ইকরামুল হক। ভারতে তিনি নূর হোসেন নামে পাসপোর্ট তৈরি করেন। জঙ্গিদের ব্যবহৃত গোপন অ্যাপসে তিনি আবু তালহা ও মনসুর নামেও পরিচিত ছিলেন। বাংলাদেশে গ্রেপ্তারের পর ইকরামুল আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ওই জবানবন্দি ও পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে উঠে আসে– দেওবন্দে থাকার সময় আল কায়দাপন্থি অনেক শীর্ষ জঙ্গির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছেন তিনি। একিউআইএসের প্রধান ওয়াসিম ওমরের সঙ্গেও তাঁর দফায় দফায় সাক্ষাৎ হয়েছিল। সম্প্রতি ওয়াসিম মারা যান। ইকরামুল উর্দু ও ইংরেজিতে পারদর্শী। সাংগঠনিক কাজে তিনি একাধিকবার আসাম, কোচবিহার, দিল্লি, ভোপালসহ কয়েকটি জায়গা সফর করেন। ২০২০ সালের জুনে অবৈধভাবে বাংলাদেশে ঢোকেন তিনি। ময়মনসিংহের বাসিন্দা ফারিয়া আফরিন অনিকাকে বিয়ে করে দুই মাস পর দেওবন্দে ফিরে যান। পরে স্ত্রীকেও অবৈধভাবে ভারতে নেন। পরিচয় গোপন করে কিছুদিন দেওবন্দের একটি মাদ্রাসায় চাকরি করতেন। ইকরামুলের স্ত্রী জঙ্গি সংগঠনের নারী শাখার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন বলে জানায় সিটিটিসি।
আনসার ইসলামের নেতা তামিম আল আদনানী ও আবু ইমরানের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে ইকরামুলের। সংগঠনের দাওয়াতি কাজের জন্য স্পেশাল সিকিউরিটি মডিউল তৈরি করেছিলেন তিনি। তাঁর কাছ থেকে জব্দ করা ইলেকট্রনিকস ডিভাইস পরীক্ষা করে দেখা গেছে, আনসার আল ইসলামের মতাদর্শে বিশ্বাসের সমর্থনমূলক অনেক অডিও, ভিডিও এবং স্থিরচিত্র সেখানে রয়েছে। এমনকি শীর্ষ জঙ্গি নেতার সঙ্গে তাঁর দিনের পর দিন চ্যাটিং রয়েছে, যেখানে নানামুখী নির্দেশনা দিচ্ছিলেন ইকরামুল।
একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, ২০২২ সালের মার্চ মাসে ভারতের এটিএস ও কলকাতা পুলিশ পৃথকভাবে দেশটিতে বেশ কয়েকজন জঙ্গিকে গ্রেপ্তারের পর ঘনিষ্ঠ সহযোগী আমানের নির্দেশে স্ত্রীসহ গোপনে বাংলাদেশে চলে আসেন ইকরামুল। এর পর অনলাইন ও অফলাইনে দাওয়াতি কার্যক্রম চালাতে থাকেন। আগের সব গোপন আইডি বন্ধ করে বেলাল নামে একজনের নতুন আইডি থেকে অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। জানা গেছে, ইকরামুলের মতো একিউআইএসের আরও বেশ কয়েকজন জঙ্গি সীমান্ত অতিক্রম করে এখন দেশে অবস্থান করছে।
সিটিটিসির ডিসি এসএম নাজমুল হক বলেন, ইকরামুলের অন্য সহযোগীদের ধরতে একাধিক টিম কাজ করছে। তাদের আর্থিক নেটওয়ার্ক বিষয়ে জানার চেষ্টা চলছে। স্ত্রীসহ তাঁকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে জঙ্গিবাদের একটি বড় নেটওয়ার্কের গোপন নানা তথ্য সামনে এসেছে। এই গ্রুপটি আল কায়দার আদর্শে বিশ্বাসী।
সুত্রঃ দৈনিক সমকাল