দুই পাশে দুজন দেহরক্ষী। তাদের হাতে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র একে-৪৭। পাহাড়ের গহিন আস্তানায় লুকিয়ে চলাফেরা করে। এই দৃশ্যের কথা মনে করলেই ভেসে আসে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী আল-কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেনের কথা। সেই ওসামা বিন লাদেনের মতোই চলাফেরা করতো নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শ্বারকিয়ার নেতা শামীন মাহফুজ। সেও দুই জন অস্ত্রধারী দেহরক্ষী নিয়ে চলাফেরা করতো পার্বত্য অঞ্চলের গহিন পাহাড়ে। সেখানেই গড়ে তুলেছিল জঙ্গি ক্যাম্প। তার ইচ্ছা ছিল—ওসামা বিন লাদেনের মতো হওয়া। কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের কাছে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য দিয়েছে শামীন মাহফুজ। জিজ্ঞাসাবাদে শামীন মাহফুজ বলে, ‘আমিই আল-কায়েদা। আমিই বাংলার ওসামা বিন লাদেন।’
গত ২৩ জুন রাজধানীর ডেমরা এলাকা থেকে স্ত্রীসহ গ্রেফতার করা হয় জামাতুল আনসারের শীর্ষ জঙ্গি নেতা শামীন মাহফুজকে। প্রথম দফা শেষে দ্বিতীয় দফায় রিমান্ডে নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট (সিটিটিসি)।
সিটিটিসির উপ-কমিশনার এস এম নাজমুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, শামীন মাহফুজকে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রয়েছে। তার কাছ থেকে অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। প্রয়োজনে তাকে আবারও রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ২০০৬ সালে প্রথম জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে শামীন মাহফুজ। প্রথমে সে জামাতুল মুসলেমিনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। এরপর জাম’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) হয়ে কাজ করেছে কিছু দিন। এরপর যোগ দেয় আনসার আল ইসলামের সঙ্গে। আনসার আল ইসলামের শীর্ষ নেতা মাওলানা ওসমান গণি ওরফে আবু ইমরানের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের তথ্য পেয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, শামীন মাহফুজের ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক্স উপকরণ থেকে তার সব যোগাযোগের তথ্য-উপাত্ত বের করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে—দেশি-বিদেশি শীর্ষ অনেক জঙ্গি নেতার সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। আল-কায়েদার অন্যতম শীর্ষ নেতা এজাজ আহমেদ কারগিলের সঙ্গেও তার যোগাযোগ ছিল। পাকিস্তানি নাগরিক এজাজ আহমেদ কারগিল বাংলাদেশি নাগরিক নাজনীন সুলতানাকে বিয়ে করেছিল। পরে এজাজ আফগানিস্তানে চলে যাওয়ার আগে স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়ে শামীন মাহফুজের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে যায়। এই এজাজ আহমেদ কারগিল আফগানিস্তানে মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হয়েছে।
সূত্র জানায়, জামাতুল আনসারের শীর্ষ নেতা শামীন মাহফুজকে ২০১৪ সালে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ একবার গ্রেফতার করেছিল। এ সময় প্রায় চার বছর কারাগারে ছিল সে। কারাগারে থাকাকালীন তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল আরেক নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী-বাংলাদেশের (হুজিবি) নেতা মাওলানা আবু সাঈদের সঙ্গে। আবু সাঈদের পরামর্শেই নতুন জঙ্গি সংগঠন তৈরির পরিকল্পনা করে শামীন মাহফুজ। ২০১৮ সালে জেল থেকে জামিনে বের হয়ে জামাতুল আনসার গড়ে তোলে সে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা শামীন মাহফুজ গবেষণার কাজে অনেক আগে থেকেই পার্বত্য অঞ্চলে যাতায়াত করতো। পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি চিনের নেতা নাথান বমের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তার বন্ধুত্ব হয়েছিল। সেই সূত্র ধরে ২০১৯ সাল থেকে পাহাড়ে জঙ্গি আস্তানা গড়ে তোলার পরিকল্পনা করে শামীন মাহফুজ।
পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, শামীন মাহফুজকে ২০১১ সালেও বান্দরবানে জিহাদি বইপত্রসহ একবার গ্রেফতার করেছিল বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। ওই সময় সে পাহাড়ে জমি বরাদ্দ নিয়ে কৃষি খামারের আড়ালে জঙ্গি আস্তানা তৈরি করছিল। সেই সূত্র ধরেই ২০১৯ সালে সে নতুন করে আবারও পাহাড়ের জঙ্গি আস্তানা গড়ে তোলে গাইবান্ধার বাসিন্দা এই শীর্ষ জঙ্গি নেতা।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ২০১৮ সালে কারাগার থেকে বের হয়ে নতুন জঙ্গি সংগঠনের একটি সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি করে শামীন। সে সময় নামহীন ওই সংগঠনের আমিরের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল মাইনুল হাসান রক্সিকে। ২০২১ সালের ৪ মার্চ কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের অভিযানে সায়েদাবাদ এলাকা থেকে মাইনুল ইসলাম ওরফে মাহিন ওরফে মিঠু ওরফে হাসান ওরফে রক্সিসহ সোহান সাদ ওরফে বারা আব্দুল্লাহ ও মুরাদ হোসেন কবীরকে গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তীকালে তমাল ওরফে মাহমুদ ওরফে শওকত নামে একজনকে আমিরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সম্প্রতি তমালকে গ্রেফতার করেছে র্যাব।
জিজ্ঞাসাবাদে শামীন মাহফুজ জানিয়েছে, জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শ্বারকিয়ার পরিকল্পনা ছিল—আনসার আল ইসলামের মতোই টার্গেটেড কিলিং করা। তারা পুলিশ, বিচারক, নাস্তিক লেখক, মুক্তমনা ব্লগার, সংবাদ পাঠক, মিডিয়া, নাট্যকর্মী, ট্রান্সজেন্ডার, এলজিবিটি কর্মীসহ সেক্যুলার চিন্তা করেন—এমন ব্যক্তিদের একটি তালিকাও করেছিল। অপারেশন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য জামাতুল আনসার ইসলামিক রিসার্চ অ্যানালাইসিস উইংয়ের (আই-র) নামে শাখাও খুলেছিল।
জিজ্ঞাসাবাদে শামীন জানায়, সে ও তার দল পুরোটাই আল-কায়েদার মতাদর্শে বিশ্বাসী। আল-কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্ট (একিউআইএস)-এর সহযোগী হিসেবে সে একটি সামরিক গ্রুপ তৈরি করার চেষ্টা করছিল। প্রতি মাসে সে আনসার আল ইসলামের কেন্দ্রীয় ফান্ড থেকে ২০ হাজার করে টাকাও পেতো।
জিজ্ঞাসাবাদে শামীন জানিয়েছে, একিউআইএসের অন্যতম প্রোপাগান্ডা প্রচারের উৎস উম্মাহ নেটওয়ার্কে শাইখ তামিম আল আদনানীর সঙ্গেও তার যোগাযোগ ছিল। সে তামিম আল আদনানীর জন্য স্ক্রিপ্ট তৈরি করেও পাঠিয়েছে। উম্মাহ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে একিউআইস দক্ষিণ এশিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে তাদের প্রোপাগান্ডা প্রচার করে আসছে।
সুত্র: বাংলা ট্রিবিউন