পাহাড়ে কেএনএফ উগ্রবাদীরা ও গ্রেফতার শীর্ষ জঙ্গি শামিন মাহফুজ/ছবি: সংগৃহীত
বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ে দীর্ঘদিন সক্রিয় কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ে ২০১৭ সালে গড়ে ওঠে উগ্রবাদী এ সংগঠন। ২০২১ সালে তারা নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার’ সদস্যদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু করে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে গোপনে ‘ঘরছাড়া’তরুণদের পাহাড়ে জড়ো করা হয়। কেএনএফের প্রশিক্ষণ সহায়তায় শক্তিশালী হয়ে ওঠে জঙ্গি সংগঠন হিন্দাল শারক্বীয়া। প্রশিক্ষিত সদস্যদের দিয়ে দেশে বড় ধরনের হামলার পরিকল্পনা করে জঙ্গিরা। বান্দরবানে যে অস্ত্র প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে হিন্দাল শারক্বীয়া শক্তিশালী হয়ে ওঠে, সেখানে সব খরচ জুগিয়েছেন এ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা শামিন মাহফুজ। তিনি অস্ত্র, খাদ্যসামগ্রী কেনাসহ পাহাড়ে জঙ্গি ক্যাম্পে সব খরচ পাঠাতেন। তার নেতৃত্বেই দেশ-বিদেশ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে নতুন এ জঙ্গি সংগঠনটি। তবে এক্ষেত্রে জঙ্গি প্রশিক্ষণ বা সংগঠনের নাম ব্যবহার করেননি তারা। ধর্মভীরু মানুষদের পাহাড়ে মসজিদ নির্মাণ, ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেওয়াসহ ধর্মীয় কাজে খরচের কথা বলতেন শীর্ষ এ জঙ্গি।
নতুন এ জঙ্গি সংগঠনের যারা সদস্য হয়েছিলেন, বেশিরভাগ অর্থায়ন তারা নিজেরাই করেছেন। কেউ কেউ ব্যাংকে জমানো টাকা তুলে, কেউবা পরিচিতদের কাছ থেকে ইসলামি শাসন কায়েমের আন্দোলনে ফান্ডিংয়ের (তহবিল গঠন) কথা বলেও টাকা নেন। এমনকি পাহাড়ে মসজিদ নির্মাণ ও ইসলামের দাওয়াতি কার্যক্রমের কথা বলেও অর্থ সংগ্রহ চালাতো জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সদস্যরা
গত ২৩ জুন রাতে রাজধানীর ডেমরা এলাকা থেকে শামিন মাহফুজ ও তার স্ত্রী নাজনীনকে গ্রেফতার করা হয়। এর পর তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি পুলিশকে এসব তথ্য জানান। জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার জঙ্গিরা শামিন মাহফুজকে আরিফ, মেন্ডিং, আসলাম, স্যার নামেও চেনেন বলে জানায় পুলিশ। শামিন মাহফুজকে গ্রেফতারের মাধ্যমে হিন্দাল শারক্বীয়ার অধ্যায়ের শেষ হবে বলে মনে করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা।
তবে নতুন এ জঙ্গি সংগঠনের ভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা ছিল বলে জানতে পেরেছে পুলিশ। এ প্রসঙ্গে তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘হলি আর্টিসান হামলার পর একাধিক জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের গ্রেফতার করে পুলিশ। এ কারণে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার প্রথম টার্গেট ছিল পুলিশ। তাদের ধারণা ছিল- পুলিশের ওপর হামলা করলে মনোবল ভেঙে যাবে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলার পরিকল্পনাও ছিল তাদের।’
কে এই শামিন মাহফুজ
ছাত্রজীবন থেকেই অত্যন্ত মেধাবী শামিন মাহফুজ। এসএসসিতে রাজশাহী বোর্ডে পঞ্চম স্থান অর্জন করেন তিনি। এরপর রংপুর ক্যাডেট কলেজে শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে এলে তাকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর অন্য কলেজে ভর্তি হয়ে সেখানেও মেধার সাক্ষর রাখেন তিনি। এইচএসসিতে রাজশাহী বোর্ডে সপ্তম স্থান অর্জন করেন শামিন মাহফুজ।
সিটিটিসি জানায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) ভর্তি হওয়ার পরে বড় ভাইয়ের ছেলের মাধ্যমে শামিন জঙ্গি সংগঠনে জড়িয়ে পড়েন। যে সংগঠনটি পরে ‘আনসার আল ইসলাম’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ২০০৭ সাল থেকেই শামিন মাহফুজ সংগঠনের আধ্যাত্মিক নেতা জসীম উদ্দিন রহমানীসহ শীর্ষ নেতৃত্বের সংস্পর্শে আসেন। সেসময় আরেকটা ‘বিদেশি চরিত্র’ বাংলাদেশের জঙ্গিবাদে আবির্ভূত হয়। তবে সেই চরিত্র বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী স্পষ্ট হতে পারেনি। ওই চরিত্র বিষয়ে শামিন মাহফুজের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করবো।
ঢাবির ছাত্র থাকাকালে শামিন মাহফুজ পাহাড়ে ক্যাম্পের পরিকল্পনা করেন। সে অনুযায়ী- তিনি পাহাড়ে যান। ঢাবি থেকে লেখাপড়া শেষে বেরিয়ে তিনি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। এর মধ্যেই তার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডিতে এনরোলমেন্ট হয়। তার গবেষণার বিষয় ছিল পাহাড়ে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর। ইচ্ছা করেই তিনি এ বিষয়টি নেন, যাতে তিনি পাহাড়ে যেতে পারেন এবং সেখানে নিরাপদ আস্তানা গড়তে পারেন।
শামিন মাহফুজ ২০১১ সালে বিজিবির হাতে গ্রেফতার হন। জেল থেকে বেরিয়ে একই কার্যক্রম অব্যাহত রাখেন। ২০১৪ সালে ডিবি তাকে আবারও গ্রেফতার করে। এরপর তিনি গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে ছিলেন। সেখানে থাকাকালীন নতুন এ জঙ্গি সংগঠনের প্রথম পরিকল্পনা হয়। সেখানে থাকা অবস্থায় আটক হুজি এবং জেএমবির শীর্ষ নেতৃত্ব সাইদুর রহমান, মুফতি হান্নান, আবু সাঈদের সংস্পর্শে আসেন। তখন রক্সিও জেলখানায় ছিলেন।
সেসময় জঙ্গি নেতারা জানতো শামিন মাহফুজ ও রক্সি আগেই জেল থেকে বের হবেন। তাই তাদের ওপর নতুন প্ল্যাটফর্ম তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০১৭ সালে রক্সি এবং ২০১৮ সালে শামিন মাহফুজ জামিন পেয়ে জেল থেকে বের হন। এরপর থেকে তারা সদস্য সংগ্রহ শুরু করেন। কিন্তু সংগঠনের নামকরণ তখনো হয়নি। তবে তারা একটি প্ল্যাটফর্ম নিয়ে কাজ করতে থাকেন।
রক্সি দাওয়াতি কার্যক্রম এবং শামিন মাহফুজ পাহাড়ে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু করেন। তখন ২০১৯ সালে রক্সিকে সংগঠনের আমির হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ঢাবির ছাত্র থাকাকালে শামিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল কুকি চিনের প্রধান নাথান বম। শামিন উদ্দেশ্যমূলকভাবে নাথান বমের সঙ্গে পরিকল্পনা করে ঘনিষ্ঠ হন। তখনই নাথান বমের সঙ্গে পাহাড়ে বেড়াতে যান শামিন। ২০১৯ সালে নাথান বমকে জঙ্গি সংগঠন তৈরির কথা জানান এবং সশস্ত্র জিহাদের প্রস্তুতির জন্য তাকে ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপনের প্রস্তাব দেন।
হলি আর্টিসান হামলার পর একাধিক জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের গ্রেফতার করে পুলিশ। এ কারণে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার প্রথম টার্গেট ছিল পুলিশ। তাদের ধারণা ছিল- পুলিশের ওপর হামলা করলে মনোবল ভেঙে যাবে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলার পরিকল্পনাও ছিল তাদের
২০২০ সালে কক্সবাজারের একটি হোটেলে বসে কুকি চিন ও নতুন জঙ্গি সংগঠন শারক্বীয়ার মধ্যে সমঝোতা সই হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শামিনের কাছ থেকে হাতে লেখা দুই পৃষ্ঠার স্মারকটি উদ্ধার করেছে। সেখানে কুকি চিন কর্তৃক জঙ্গি সংগঠনটিকে সহযোগিতার বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ ছিল। তখন থেকেই কুকি চিনের আওতায় তাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়।
বিদেশ থেকে অর্থ-অস্ত্র জোগানে জঙ্গি মায়মুন
জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার অন্যতম সদস্য ও দাওয়াতি শাখার প্রধান ছিলেন আব্দুল্লাহ মায়মুন। অভিনব কৌশলে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অর্থ ও অস্ত্রের জোগান দিতেন। গত ৮ মে দিনগত রাতে সিলেট বিমানবন্দর থানার বড়শালা এলাকায় অভিযান চালিয়ে মায়মুনসহ চার জঙ্গিকে গ্রেফতার করে র্যাব।
সিটিটিসির অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) আতিকুর রহমান চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘শারক্বীয়ার নেতা শামিন মাহফুজ রিমান্ডে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। সেই তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। কেএনএফের সঙ্গে মাসে সাড়ে তিন লাখ টাকার চুক্তি হয়েছিল শামিন মাহফুজের। তার টার্গেট ছিল জঙ্গি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তরুণদের দিয়ে বড় ধরনের হামলার জন্য প্রস্তুত করা এবং ইসলামি শাসন কায়েমের নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে নামানো।’
তিনি বলেন, ‘নতুন এ জঙ্গি সংগঠনের যারা সদস্য হয়েছিলেন, বেশিরভাগ অর্থায়ন তারা নিজেরাই করেছেন। কেউ কেউ ব্যাংকে জমানো টাকা তুলে, কেউবা পরিচিতদের কাছ থেকে ইসলামি শাসন কায়েমের আন্দোলনে ফান্ডিংয়ের (তহবিল গঠন) কথা বলেও টাকা নেন। এমনকি পাহাড়ে মসজিদ নির্মাণ ও ইসলামের দাওয়াতি কার্যক্রমের কথা বলেও অর্থ সংগ্রহ চালাতো জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সদস্যরা।’
সিটিটিসি প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘শামিন মাহফুজ গ্রেফতারের কিছুদিন আগে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকও করেছেন। কার কার সঙ্গে বৈঠক করেছেন এবং তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে বিস্তারিত জানতে কাজ শুরু করেছি আমরা।’
সুত্রঃ জাগো নিউজ ২৪ কম