আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে জঙ্গিরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশে জঙ্গি সংগঠন আল কায়েদা বা একিউআইএসের কোনো অস্তিত্ব নেই।
তবে আল-কায়েদার মতাদর্শের অনুসারী দেশীয় জঙ্গি সংগঠনের তৎপরতা রয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে সাধারণত রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে বিভিন্ন সময়ে জঙ্গিদের মদদ দেওয়া হয়েছে। ফলে নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশীয় পৃষ্ঠপোষক কিংবা বাইরের অনেক দেশও জঙ্গিদের মদদ দিয়ে থাকতে পারে। এরই মধ্যে গত ২৫ জুলাই জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ, ভারতের জম্মু-কাশ্মির ও মিয়ানমারে তৎপরতা বাড়াতে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদা তাদের আঞ্চলিক মিত্র দলগুলোকে আবারও ‘সংগঠিত’ করছে বলে সতর্ক করা হয়েছে। যদিও দেশের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে এই মুহূর্তে আল-কায়েদার স্পষ্ট কোনো তৎপরতা নেই। তারপরও জাতিসংঘের প্রতিবেদনের প্রেক্ষাপটে আল-কায়েদার অস্তিত্ব খুঁজতে মাঠে নেমেছেন গোয়েন্দারা।
জানা যায়, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের আল-কায়েদা স্যাংশন্স কমিটির ৩২তম প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আল-কায়েদা এখন একিউআইএসকে (আল-কায়েদা ইন দ্য ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্ট) সংগঠিত করছে। তাদের লক্ষ্য বাংলাদেশ, ভারতের জম্মু-কাশ্মির এবং মিয়ানমারে সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা বাড়ানো। একিউআইএসের অল্প কিছু সদস্য ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড দ্য লেভান্ত-খোরাসানের (আইএসআইএলকে) সঙ্গে যোগ দিতে বা তাদের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত বলেও মনে করছে ওই সদস্য রাষ্ট্র। প্রতিবেদন অনুযায়ী, আল-কায়েদার মূল ঘাঁটি আফগানিস্তানে এখনও তাদের ৩০-৬০ জন সদস্য রয়েছে। আর যোদ্ধা রয়েছে প্রায় ৪০০ জন। পরিবারের সদস্য ও সমর্থক মিলিয়ে এ সংখ্যা ২ হাজারে পৌঁছাতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, ভারতীয় উপমহাদেশে আল-কায়েদার প্রায় ২০০ যোদ্ধা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সম্ভবত তাদের নেতা ওসামা মেহমুদ।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের বিশিষ্ট নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ সময়ের আলোকে বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশের এই অঞ্চলে জঙ্গিদের যে ঝুঁকি সেটা একেবারে নির্মূল হয়নি। ফলে যেকোনো প্রেক্ষাপটে জঙ্গিরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতেই পারে। তবে একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, জঙ্গিদের মাথাচাড়া দেওয়ার পেছনে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা বা মদদ থাকে। পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলে তারা বেশিক্ষণ তৎপরতা চালাতে পারবে না। জাতিসংঘের যে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে সেটা কতটা বাস্তবসম্মত সেটা আগে নিশ্চিত হওয়া দরকার।
এটি সম্ভবত ধারণাভিত্তিক প্রতিবেদন। ধারণাভিত্তিকও হলেও এ বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখতে হবে। যদিও বাংলাদেশ বা ভারত অঞ্চলে দেশীয় জঙ্গি ছাড়া অন্যদের তেমন কোনো তৎপরতা দেখা যায় না। তারপরও ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দেশীয় পৃষ্ঠপোষক কিংবা বাইরের অনেক দেশ পেছন থেকে জঙ্গিদের মদদ দিয়ে থাকতে পারে। এ বিষয়ে দেশের নিরাপত্তা বাহিনী এবং সাধারণ নাগরিকদেরও সতর্ক এবং সচেতন থাকতে হবে।
এ প্রসঙ্গে জঙ্গিবাদ বিরোধী অভিযানে অন্যতম প্রধান ভূমিকা রাখা এলিট ফোর্স র্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈনের সঙ্গে কথা হয় সময়ের আলোর সঙ্গে। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার এই পরিচালক বলেছেন, জাতিসংঘের ওই প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই আমাদের গোয়েন্দারা এ বিষয়ে কাজ শুরু করেছেন। কমান্ডার আল মঈন বলেন, বর্তমানে দেশে জঙ্গি সংগঠন ‘আনসার আল ইসলাম’ সবচেয়ে বেশি তৎপর রয়েছে। এ ছাড়া জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার আমিরসহ অনেকেই গ্রেফতার হলেও সেই নিরুদ্দেশ হওয়া ৫৫ জনের মধ্যে এখনও ৭-৮ জন পলাতক অবস্থায় আছে। ফলে তাদের এখনও হুমকি হিসেবে ধরা হচ্ছে। অন্যদিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন কেএনএফের ঘাঁটিতে পাহাড়ে অস্ত্র প্রশিক্ষণের ভিডিওতে যাদের দেখা গেছে সেই ‘কারসে’ এবং ‘সিমরাত’ নামের দুই জঙ্গি আত্মগোপনে আছে। এর মধ্যে কারসে প্রশিক্ষণ কমান্ডার এবং সিমরাত হিন্দাল শারক্বীয়ার সামরিক কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। এসব বিষয়ে র্যাব নানা পর্যায়ে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার সহকারী পরিচালক আ ন ম ইমরান খান সময়ের আলোকে জানান, চলতি বছরের এই সময় পর্যন্ত বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের ৭৪ জন সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। এর মধ্যে কেবল হিন্দাল শারক্বীয়ার ৪৪ জন। এ ছাড়া ২০২২ সালে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের ১৭০ জন এবং তার আগের বছর ২০২১ সালে ২৯৬ জন জঙ্গিকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় র্যাব। অন্যদিকে র্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ৩০ জুন পর্যন্ত বিভিন্ন সংগঠনের মোট ২ হাজার ৯৫৩ জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
এদিকে দেশে আল-কায়েদার তৎপরতা সম্পর্কে জানতে চাইলে ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মো. আসাদুজ্জামান সময়ের আলোকে বলেন, বাংলাদেশে আল-কায়েদার কোনো অস্তিত্ব নেই। তবে আল-কায়েদার মতাদর্শের দেশীয় জঙ্গি সংগঠন বা জঙ্গিরা তৎপর আছে। বিশেষ করে আনসার আল ইসলাম সেই মতাদর্শে বর্তমানে নানাভাবে তৎপরতা চালাচ্ছে বলে গোয়েন্দাদের কাছে খবর আসছে। যদিও সেটা অনলাইন মাধ্যমেই বেশি। তারপরও সার্বিক বিষয়ে নজরদারি চালানো হচ্ছে। জঙ্গিরা প্রকাশ্যে যেখানেই তৎপরতা চালাবে সেখানেই তারা ধরা পড়বে।
প্রসঙ্গত, গত রোববার পাকিস্তানে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বোমা হামলায় প্রায় অর্ধশত মানুষ নিহত হওয়া এবং জাতিসংঘের সতর্কতামূলক প্রতিবেদন প্রকাশের পর দেশে জঙ্গি তৎপরতার বিষয়টি আবারও আলোচনায় এসেছে। বিশেষ করে আফগানিস্তানে বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধে অংশ নেওয়া কিছু জঙ্গিদের ঘিরেই সেই সন্দেহ করা হয় বারবার।
সুত্রঃ সময়ের আলো