বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের একটি জেলা মৌলভীবাজারে অভিযান চালিয়ে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করার পরে পুলিশ বলছে, এরা নতুন একটি জঙ্গি দলের সদস্য।
এই দলটির নাম ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা,’ যারা গত কয়েকমাস ধরে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছিল।
সোমবার গ্রেপ্তার করা নয়জনকে আদালতের হাজির করলে আদালত তাদেরকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। অন্যদিকে সোমবার মৌলভীবাজারেই এই জঙ্গি দলের সদস্য সন্দেহে আরও ১৭ জনকে আটক করেছে স্থানীয় পুলিশ। ঢাকা থেকে কাউন্টার টেরোরিজমের একটি দল গিয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে।
বাংলাদেশে গত দশকের মাঝামাঝি সময়ে জঙ্গি তৎপরতা অনেক বেড়ে গেলেও পর পুলিশের অভিযানের মুখে তা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। কিন্তু গত বছর থেকে পুনরায় কিছু কিছু জঙ্গি তৎপরতার খবর পাওয়া যাচ্ছে।
গত কয়েকমাস ধরে ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’ নামে নতুন এই জঙ্গি দলের কর্মকাণ্ড চলছে বলে জানা যায়।
কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) প্রধান ও অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোঃ আসাদুজ্জামান বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘’কথিত ইমাম মাহমুদ নামে কিছুদিন আগে জঙ্গি দলটি সংগঠিত হতে শুরু করে। এর অনুসারীরা মনে করেন, ইমাম মাহাদীর অগ্রবর্তী হিসাবে ইমাম মাহমুদ অবতীর্ণ হয়েছেন। বিভিন্ন হাদিস গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, ইমাম মাহাদীর আগে ইমাম মাহমুদ নামে দুর্বল প্রকৃতির একজন ব্যক্তির আবির্ভাব হবে।”
এই কথিত ইমাম মাহমুদের দলকে বলা হতো কাফেলা। তাদের বিশ্বাস, ইমাম মাহমুদের নেতৃত্বে ভারতীয় উপমহাদেশে জিহাদের নেতৃত্ব দেয়া হবে। তাতে অংশ নেয়ার প্রথম ধাপ হলো হিজরত বা গৃহত্যাগ করে দলে যোগ দেয়া। যারা এভাবে জিহাদে অংশ নেবে, তারা পরকালে পুরস্কারপ্রাপ্ত হবে।
এই বিশ্বাস থেকে বিভিন্ন এলাকার লোকজন বাড়ি ছেড়ে মৌলভীবাজারের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় জঙ্গিদের ক্যাম্পে হাজির হচ্ছিল।
ঢাকার পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, এই দলটি বেশ কিছুদিন ধরে গোপনে তাদের কর্মকাণ্ড শুরু করেছিল। তবে পুলিশের নজরে আসার পরে তারা এদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছেন।
মোঃ আসাদুজ্জামান বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘’যশোর, সিরাজগঞ্জ, জামালপুরসহ বিভিন্ন জেলা থেকে সম্প্রতি অনেক লোক পরিবারসহ এবং পরিবার ছাড়া নিখোঁজ হওয়ার তথ্য পাওয়া যাচ্ছিল। সেটা তদন্ত করতে গিয়েই আমরা সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানার ডাঃ সোহেল তানজীন রানা, যশোর থেকে নটরডেমের শিক্ষার্থী ফাতিম, জামালপুরের এরশাদুজ্জামান শাহিন সম্পর্কে অনেক তথ্য জানতে পারি। সেই তদন্তের অংশ হিসাবেই আমরা এই নতুন জঙ্গি দলের খোঁজ পাই।‘’
তদন্তের অংশ হিসাবে গত সাতই অগাস্ট ঢাকার গাবতলি এলাকা থেকে ঝিনাইদহ এবং মেহেরপুর থেকে আসা ছয় জন নারী আর চারজন পুরুষকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাদের সাথে আটটি বাচ্চাও ছিল। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ জানতে পারে, তারা সবাই ইমাম মাহমুদের কাফেলায় যোগ দেয়ার জন্য ‘হিজরত’ করছে।
এরপর ঢাকার মিরপুর বাংলা কলেজ এলাকায় অভিযান চালিয়ে একজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।তার কাছে তারা জানতে পারে, মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার একটি দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় কথিত ইমাম মাহমুদের বেশ কিছু অনুসারী আস্তানা তৈরি করেছে। তাদের একজন অনুসারী কুলাউড়ার কর্মধা ইউনিয়নের টাট্টিউলি গ্রামে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপনের জন্য জমিও ক্রয় করেছিল। শনিবার সেখানে অভিযান চালিয়ে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোঃ আসাদুজ্জামান বলেন, ‘’জিহাদ করার লক্ষ্যে এরা আস্তে আস্তে সংগঠিত হতে শুরু করেছিল।‘’
জঙ্গিরা কী আবার সংগঠিত হচ্ছে?
পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, পুলিশের সাড়াশি অভিযানে জঙ্গি কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ আনা হলেও এদের আসলে সম্পূর্ণ নির্মূল করা কঠিন। তবে নজরদারি অব্যাহত থাকলে এভাবে কর্মকাণ্ড শুরু করার আগেই তাদের ধরে ফেলা যায়।
জঙ্গি তৎপরতা বিষয়ক বিশ্লেষক নূর খান লিটন বিবিসি বাংলাকে বলেন, পুলিশের বক্তব্যের আগে এই জঙ্গি দলের কথা তিনি আগে শোনেননি।
তিনি বলেন, ‘’সাম্প্রতিককালে এই সংগঠন এবং কিছুদিন আগে আরেকটি সংগঠনের নাম আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকেই শুনেছি। কিন্তু নির্ভরযোগ্য কোন স্বাধীন সূত্র থেকে আমি এদের সম্পর্কে কোন তথ্য পাইনি। ফলে এদের সম্পর্কে মন্তব্য করা খুব কঠিন।‘’
কোন জঙ্গি সংগঠনের অস্তিত্ব পুরোপুরি শেষ হয়ে যায় না মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘’দেখতে হবে তাদের দৃশ্যমান কোন তৎপরতা চালানোর মতো সক্ষমতা আছে কিনা। এদের তেমন কোন সক্ষমতা আছে বলে আমার মনে হয় না। তারা জোরালো কোন তৎপরতা চালাতে পারে, সেরকম কোন তথ্যও আমি পাইনি।
বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা এখন কোন অবস্থায় আছে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘’একটা জিনিস খুব স্পষ্ট, আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গত কয়েক বছরের অভিযানে, সেটা মানবাধিকার লঙ্ঘন করেই হোক আর যেভাবে হোক, যে পরিমাণ লোকজনকে আটক করা হয়েছে, এর ফলে জঙ্গিদের অস্তিত্ব কিন্তু হুমকির মুখে পড়েছে। এখন পর্যন্ত সেটা উৎরিয়ে তারা কোন অপারেশন করার সক্ষমতা অর্জন করেছে, সেটা আমি মনে করি না।‘’
তবে পুলিশ কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান বলছেন, ‘’জঙ্গিরা তো গোপনে গোপনে কাজ করে, তার তো আর ঘোষণা দিয়ে কাজ করবে না। তবে শক্ত কোন অবস্থান তৈরি করার আগে, প্রকাশ্য হওয়ার আগেই আমরা অভিযান চালিয়ে আটক করছি। ফলে আমাদের অভিযানের আগে অনেক সময় তাদের বিষয়ে শোনা যায় না। আমরা সমসময়েই নজরদারি অব্যাহত রাখছি।”
বাংলাদেশে ২০১৬ সালে হোলি আর্টিজান রেস্তোরায় জঙ্গি হামলায় দেশি-বিদেশি নাগরিক হতাহত হওয়ার পর জঙ্গিবিরোধী বড় ধরনের অভিযান শুরু করেছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরপর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে অনেক জঙ্গিকে আটক করা হয়। সেসব অভিযানে অনেক হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে।
বহু বছর পরে ২০২২ সালে জঙ্গি তৎপরতার বিষয়টি আবার সামনে আসে। ওই বছর অক্টোবরে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী র্যাব জানায়, বান্দরবান ও রাঙামাটির দুর্গম এলাকায় কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের প্রশিক্ষণ শিবিরে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ৫০ জনের বেশি জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। তারা জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়া নামের একটি জঙ্গি সংগঠনের সদস্য। এসব ক্যাম্পে অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
গত বছরের ২০শে নভেম্বর ঢাকার নিম্ন আদালত এলাকা থেকে পুলিশের চোখে স্প্রে করে প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনকে হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি আনসার আল ইসলাম সদস্যকে ছিনিয়ে নেয় জঙ্গিরা। তাদের এখনো আটক করা সম্ভব হয়নি।
সুত্রঃ বিবিসি বাংলা