নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনাল-৪-এ একটি ধর্ষণ মামলার বিচারকার্য চলছে। কামরাঙ্গীর চর ওয়াজউদ্দিন স্কুলের সামনে থেকে ৭ম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে অপহরণ করে সবুজ ও সোহেল নামে দুই যুবক তাকে ধর্ষণ করে—এমন অভিযোগ এনে ২০১১ সালের ১৪ ডিসেম্বর ধর্ষণের শিকার শিক্ষার্থীর মা মামলাটি করেন। কিন্তু ২৩ বছরেও সুরাহা হয়নি সেই মামলার। একই আদালতে ২০১৫ সালে কেরানীগঞ্জের এক স্কুলশিক্ষার্থীকে ধর্ষণ মামলার শুনানি শুরু হয়। সেই মামলাটিও একইভাবে ঝুলে আছে।
গত মঙ্গলবার নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনাল-৩, ৪ ও ৮ ঘুরে দেখা গেল সেগুলোতে যথাক্রমে—৩২টি, ৩৭টি ও ৭৪টি মামলার কার্যক্রম চলছে। পাবলিক প্রসিকিউটরদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিদিনই এত মামলার ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনালগুলো।
গত ১০ বছরে প্রতিটি আদালতে আড়াই হাজারের মতো মামলা কার্যক্রম চলমান আছে। সাক্ষীর অভাবে মামলার জট বাঁধে বলে তারা মনে করেন। তবে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞজনেরা বলেন, সাক্ষীর অভাবের পাশাপাশি দীর্ঘসূত্রতা মামলাজটের অন্যতম কারণ। স্বল্প সময়ে বিচার না হওয়ায় বাড়ছে নারী নির্যাতন। তারা বলেন, ২০১৫ সাল থেকে উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে যৌন সহিংসতা। এমন বাস্তবতার মধ্যে আজ দেশ জুড়ে পালিত হচ্ছে ইয়াসমিন হত্যা/নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস।
১৯৯৫ সালের এই দিনে (২৪ আগস্ট) পুলিশি হেফাজতে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়ে প্রাণ হারায় কিশোরী ইয়াসমিন। এ ঘটনায় পুরো দিনাজপুরবাসী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে, দোষীদের শাস্তি হয়। তারপর থেকে দিবসটি ইয়াসমিন হত্যা/ নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে ধর্ষণ
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের আইনজীবী অ্যাডভোকেট দীপ্তি সিকদার ইত্তেফাককে বলেন, ‘আমরা ২০১৫ সাল থেকে দেখছি উদ্বেগজনকভাবে নারী নির্যাতন, বিশেষ করে যৌন নির্যাতন বাড়ছে। তখন থেকেই আমরা অপরাধীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের কথা বলে আসছি। কিন্তু বিচারকার্যের দীর্ঘসূত্রতার জন্য এবং অনেক ক্ষেত্রে বিচার না হওয়ার কারণে সমাজে অপরাধ বাড়ছে। বাড়ছে নারীর প্রতি সহিংসতা।’ তিনি বলেন, অতিসম্প্রতি দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, প্রাপ্তবয়স্ক নারীর চেয়ে শিশু ও কিশোরী ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। ছয় বছরের শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে এমন অনেক তথ্য উঠে এসেছে আমাদের লিগ্যালএইড উপ-পরিষদের প্রতিবেদনে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে লিগ্যালএইড উপ-পরিষদ প্রতিবেদন করে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের রিপোর্ট অনুসারে চলতি বছর ছয় মাসে মোট ২২৩ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। একই সময় ১০৭ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। দীপ্তি সিকদার বলেন, বর্তমান সময়ে সাক্ষী সুরক্ষা আইন খুব জরুরি। নিরাপত্তার ভয়ে সাক্ষী পাওয়া যায় না।
বাড়ছে ট্রাইব্যুনাল, বাড়ছে মামলা
২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের জন্য একটি ট্রাইব্যুনাল করা হয়। মামলার অতিরিক্ত চাপের কারণে পর্যায়ক্রমে তা বাড়িয়ে পাঁচটি করা হয়। এতেও মামলার পাহাড় পাড়ি দেওয়া যাচ্ছিল না বলে ২০১৮ সালে নতুন করে আরও চারটি নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনাল করা হয় বলে উল্লেখ করেন নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনাল-৮-এর সরকারি বিশেষ আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ রেজাইল করিম। তিনি ইত্তেফাককে বলেন, বর্তমান সময়ে নারী ও শিশু উভয়ের প্রতি যৌন নির্যাতনের মামলা বেড়েছে। প্রতিটি ট্রাইব্যুনালে গত ১০ বছরে আড়াই হাজারের বেশি মামলা চলমান আছে। এই মামলাগুলোর নিষ্পত্তির জন্য সাক্ষীর অভাব বড় অন্তরায় বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, কোভিডের সময় করা মামলাগুলোর শুনানির সময় সাক্ষী পাওয়া যায় না। কারণ তারা এখন আর অপরাধ সংঘটিত হওয়ার স্থানে বাস করেন না। এই সমস্যা স্বাভাবিক সময়ও দেখা যায়। খবর নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে দেশের প্রায় ৯৫টি ট্রাইব্যুনালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধীনে করা প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার মামলার বিচার কার্যক্রম চলছে। তবে ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন মামলার প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি।
যৌন নির্যাতনের মামলাগুলোর বিচার সম্পন্ন করা এবং সাক্ষী সুরক্ষা আইন করা বেশি জরুরি বলে মনে করেন অ্যাডভোকেট দীপ্তি সিকদার। বিচারকার্যের পাশাপাশি সমাজকে আরও বেশি জাগ্রত হওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি গণমাধ্যমে এ বিষয়ে বেশি করে প্রচারণার ওপর জোর দিয়ে বলেন, যে কারো প্রতি এমন অপরাধ দোষনীয়, তবে শিশুর প্রতি হলে সেই নরাধমদের শাস্তি নিশ্চিতের পাশাপাশি সমাজ থেকে ঘৃণ্য বলে তাদের পরিত্যাগ করতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
সুত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাকে