১২ আগস্ট মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার পাহাড়ি এলাকার একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ( ডিএমপি)-র কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) মোট ১০ জনকে আটক করে। তাদের মধ্যে চারজন পুরুষ ও ছয়জন নারী। তাদের সঙ্গে তিনটি শিশুও আছে। তাদের কাছ থেকে বিস্ফোরক ও জিহাদি বইও উদ্ধারের কথা জানায় পুলিশ। দ্বিতীয় দফায় ১৭ জনকে আটক করা হয় ১৪ আগস্ট। তাদের মৌলভীবাজারেরই কর্মধা ইউনিয়ন এবং আশপাশের এলাকা থেকে আটক করা হয়। স্থানীয় লোকজন তাদের আটকের পর পুলিশে খবর দেয়।
তাদের আটকের পর সিটিটিসির প্রেস ব্রিফিংয়ে ইউনিটের প্রধান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, “তারা সবাই জিহাদের প্রস্তুতি নিচ্ছিল গোপন আস্তানায়। তারা মনে করে, ইমাম মাহদী আসবেন। তার আসার আগে ইমাম মাহমুদ আসবেন। ইমাম মাহমুদের নেতৃত্বে এই উপমহাদেশে জিহাদের নেতৃত্ব দেয়া হবে। তার জন্যই তারা প্রস্তুত হচ্ছিলেন।”
পুলিশ জানিয়েছে, গত কয়েক মাস ধরে তাদের তৎপরতার খবর পাওয়া যাচ্ছিল। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল, বিশেষ করে যশোর, সিরাজগঞ্জ ও জামালপুর থেকে কিছু লোক নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে তারা এর সূত্র পান। তারা জানতে পারেন, সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরের ডা. তানভীর রানা, নটরডেম কলেজের শিক্ষার্থী ফাহিম, জামালপুরের এরশাদুজ্জামান শাহীনসহ আরো কিছু ব্যক্তির ব্যাপারে তথ্য ও জঙ্গি সংগঠনটির নাম। এরপর তারা ৭ আগস্ট ঢাকার গাবতলী এলাকা থেকে ছয় নারী ও চারজন পুরুষকে আটক করেন। তাদের সঙ্গে শিশুও ছিল। পুলিশ তাদের জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে জানতে পারে যে, তারা ঝিনাইদহ ও মেহেরপুর থেকে ‘হিজরত’ করে এসেছে। তারা সবাই ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলায়’ যোগ দেবে। এরপর মিরপুর বাংলা কলেজ এলাকায় অভিযান চালিয়ে আরো একজনকে গ্রেপ্তারের পর মৌলভীবাজারের আস্তানার খবর জানতে পারে।
তবে এই জঙ্গি দলটির সঙ্গে বাংলাদেশে এর আগে পরিচিত, জেএমবি, নব্য জেএমবি, আনসার আল ইসলাম বা অন্য কোনো সংগঠনের যোগাযোগ আছে কিনা তা জানায়নি পুলিশ। মৌলভীবাজারের আস্তানা থেকে প্রথম যে ১০ জনকে আটক করা হয়েছে, তাদের মধ্যে ৯ জনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
নতুন এই জঙ্গি সংগঠনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার অভিযানের মধ্যেই ১০ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ‘জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নামে একটি জঙ্গি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করেছে। গত বছরের ২৩ আগস্ট কুমিল্লা থেকে আট কলেজ ছাত্র নিখোঁজ হওয়ার পর এই সংগঠনটি আলোচনায় আসে। এই সংগঠনের সদস্যরা বান্দরবানের পাহাড়ে ‘কুকি—চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট’ নামে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের সহায়তায় প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল। পুলিশ ও র্যাব শারক্বীয়ার শীর্ষ নেতাসহ অনেককেই গ্রেপ্তার করেছে।
জঙ্গি বিষয়ক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে হোলি আর্টিজান হামলার পর জঙ্গি সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযানের ফলে জঙ্গি সংগঠনগুলো দুর্বল ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বড় ধরনের কোনো জঙ্গি হামলা চালানোর সক্ষমতা তাদের নেই।
জঙ্গি বিষয়ক গবেষক নূর খান বলেন, “এখন জঙ্গিরা আটক হওয়ার পর আমরা নতুন নতুন জঙ্গি সংগঠনের নাম পাচ্ছি। এদের নাম আগে শোনা যায়নি। আমরা এই সব নাম পাচ্ছি, যারা অভিযান পরিচালনা করছেন, তাদের সূত্রে। তবে আস্থা রাখা যায় এমন কোনো নিরপেক্ষ সূত্র থেকে আমি এই নতুন জঙ্গি সংগঠনগুলোর ব্যাপারে কোনো তথ্য পাইনি।”
তার কথা, “নতুনদের কাছ থেকে যা পাওয়া যাচ্ছে, তাদের সঙ্গে আগের জঙ্গিদের কাছে অস্ত্র, গুলি যা পাওয়া যেতো, সেরকম মিল নেই। আমি মনে করি, বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যেভাবে শক্ত হাতে জঙ্গিদের দমন করেছে, তাতে যারা নতুন তাদের যে নামেই ডাকা হোক, তাদের বড় কোনো ঘটনা ঘটানোর সক্ষমতা নেই।”
তার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, “বাংলাদেশে নির্বাচন বা কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে জঙ্গিদের বিষয়গুলো সামনে চলে আসে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে এখন আমরা ক্রসফায়ার দেখছি না। তবে তুলে নেয়ার ঘটনার খবর আমরা পাচ্ছি। তাদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। রাজনৈতিক অস্থিরতা বেড়ে গেলে ক্রসফায়ার বা বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছি।”
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ মনে করেন, “জঙ্গিরা দুর্বল হয়ে পড়লেও তাদের মতাদর্শগত তৎপরতা থেমে নেই। এ কারণেই তারা নতুন নামে ও কৌশল পরিবর্তন করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জঙ্গি বিষয়ক সক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত তারা চিহ্নিত হয়ে যায়।”
তিনি মনে করেন, “এইসব জঙ্গির রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক আছে। আমার মনে হয়, নির্বাচনের আগে তারা সক্রিয় হয়েছে। নতুন নতুন জঙ্গি সংগঠনের জন্ম হচ্ছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, সামনে নির্বাচন আছে। যদি নির্বাচনের আগে সহিংসতা করা যায়, তাহলে নির্বাচনের গুণ ও মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়।”
তার কথা, “যারা সহিংসতার দর্শনে বিশ্বাসী, প্রগতিশীলতার বিরুদ্ধে তারা জঙ্গিদের উসকে দেয়। নতুন জঙ্গি সংগঠনের সহিংসতার দর্শন একই। তবে তারা নাম, চেহারা বা কৌশল বদলেছে। নির্জন পাহাড়ি এলাকায় আস্তানা গড়েছে। কারণ পুরনো পদ্ধতিতে এগোলো শুরুতেই তারা ধরা পড়ে যাবে।” নুর খানও মনে করেন, “জঙ্গিরা দুর্বল হয়ে গেলেও জঙ্গি দর্শনের চর্চা বন্ধ হয়নি।”
সুত্রঃ ডয়চে ভেলে DW