২০২২ সালের ২০ নভেম্বর পুরান ঢাকার নিম্ন আদালতে ঘটে যায় দেশের আলোচিত ঘটনা। চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত প্রাঙ্গণে পুলিশের হাত থেকে প্রকাশ্যে ছিনতাই হয়ে যায় নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের দুই সদস্য- মইনুল হাসান শামীম ও আবু সিদ্দিক সোহেল। এ ঘটনায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করে পুলিশ। আসামিদের ধরিয়ে দিতে নগদ পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়। কিন্তু প্রায় ১০ মাস হতে চললেও ওই দুই জঙ্গি এখনো অধরা। তারা দেশে, নাকি বিদেশে- তা এখনো শনাক্ত করতে পারেনি তদন্তে নিয়োজিত পুলিশের বিশেষ সংস্থা কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। এদিকে ছিনতাইয়ের ঘটনায় কোতোয়ালি থানার সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলার তদন্ত প্রতিবেদন পেছানো হচ্ছে বারবার। তবে ওই দুই জঙ্গিকে ধরতে নিয়মিত নানা রকম অভিযান চালাচ্ছে বলে জানিয়েছে সিটিটিসি।
জঙ্গি ছিনতাই মামলার তদারকি কর্মকর্তা সিটিটিসির অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (এডিসি) ইমরান হোসেন মোল্লা ভোরের কাগজকে বলেন, আসামি দুই জঙ্গিকে গ্রেপ্তারের জন্য আমরা এরই মধ্যে নানা অভিযান পরিচালনা করেছি। তাদের পালাতে সহায়তাকারী এক জঙ্গির স্ত্রীসহ ২০-২১ জনকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এছাড়া সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে দুই জঙ্গির ছবি পাঠানো হয়েছে। তারাও কাজ করছে।
দুই জঙ্গির অবস্থান দেশে, নাকি বিদেশে- তা শনাক্ত করা গেছে কিনা প্রশ্নে সিটিটিসির এ চৌকস কর্মকর্তা বলেন, পালানোর পর সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জে তাদের অবস্থান ছিল। বর্তমানে তাদের অবস্থান কোথায় তা শনাক্ত করা যায়নি। আমাদের গোয়েন্দা নজরদারিসহ সব ধরনের তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। যেখানেই থাক, অবস্থান শনাক্ত করা গেলে তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।
এদিকে আদালতে কোতোয়ালি থানার সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা উপপরিদর্শক মো. আশ্রাফ জানান, সন্ত্রাসবিরোধী আইনের এ মামলাটিতে তদন্ত প্রতিবেদন কয়েক দফা পিছিয়ে আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য রয়েছে। মামলার বাকি আসামিরা কারাগারে আছেন। এদিকে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আবু আব্দুল্লাহ ভোরের কাগজকে বলেন, এটি একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা। পলাতক আসামিদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনা হোক।
ছিনতাই ঘটনার দিনই ডিসি প্রসিকিউশনের পুলিশ পরিদর্শক জুলহাস বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করেন। এজাহারে বলা হয়, ২০১৫ সালে প্রকাশক দীপন হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আবু সিদ্দিক সোহেল ও মইনুল হাসান শামীমসহ আরো কয়েকজন কারাগারে ছিলেন। তারা সবাই আনসার আল ইসলামের সদস্য। নিষিদ্ধ এ জঙ্গি সংগঠনটির সামরিক শাখার প্রধান সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়ার (চাকরিচ্যুত মেজর) পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় আয়মান ওরফে মশিউর রহমান, সাব্বিরুল হক চৌধুরী ওরফে আকাশ ওরফে কনিক, তানভীর ওরফে সামশেদ মিয়া ওরফে সাইফুল ওরফে তুষার বিশ্বাস, রিয়াজুল ইসলাম ওরফে রিয়াজ ওরফে সুমন ও মো. ওমর ফারুক ওরফে নোমান ওরফে আলী ওরফে সাদ পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে আসামিদের ছিনিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করেন।
ঘটনার দিন সকাল ৮টা ৫ মিনিটে কাশিমপুর থেকে ১২ জঙ্গিকে প্রিজনভ্যানে ঢাকার আদালতে নিয়ে আসা হয়। সকাল ৯টা ৪০ মিনিটের দিকে মোহাম্মদপুর থানার একটি মামলায় আসামিদের হাজিরা দেয়ার জন্য সিজেএম আদালত ভবনের সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনাল-৮ এ নিয়ে যাওয়া হয়। মামলার শুনানি শেষে মইনুল হাসান শামীম, আবু সিদ্দিক সোহেল, আরাফাত রহমান ও মো. সবুরকে হাজতখানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। এ সময় মূল ফটকের সামনে পৌঁছামাত্র আগে থেকেই দুটি মোটরসাইকেলে আনসার আল ইসলামের অজ্ঞাতনামা ৫-৬ জন সদস্য এবং আদালতের আশপাশে অবস্থান নেয়া তাদের আরো ১০ থেকে ১২ জন সদস্য হামলা করে। একজন লোহা কাটার যন্ত্র দিয়ে কর্তব্যরত পুলিশ মো. আজাদকে হত্যার উদ্দেশে আঘাত করলে মুখে লেগে নাক ও মুখে গুরুতর জখম হন। এরপর সিজেএম কোর্ট গেটের নিরাপত্তাহীকর্মী মো. তারেক জিয়া এগিয়ে এলে তাখ চোখে পিপার স্প্রে (মরিচের গুঁড়া) ছিটালে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এরপর শামীম ও সোহেল মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যান। তবে বাকি পুলিশরা চলে এসে আরাফাত ও সবুরকে ধরে ফেলে।
আটক আরাফাত ও সবুরকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তাদের সংগঠনের সামরিক শাখার সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক ওরফে চাকরিচ্যুত মেজর জিয়ার পরিকল্পনা ও নির্দেশ মোতাবেক এ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। সেদিন রাতেই কারাগারে থাকা বাকি ১০ জঙ্গিকে রিমান্ডে নেয়া হয়। তারা হলেন- শাহিন আলম, শাহ আলম, বিএম মজিবুর রহমান, সুমন হোসেন পাটোয়ারী, খায়রুল ইসলাম, মোজাম্মেল হোসেন, আরাফাত রহমান, শেখ আব্দুল্লাহ, আব্দুস সবুর ও রশিদুন্নবী।
পরে ছিনতাই ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরো কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। মেহেদী হাসান নামে এক জঙ্গিকে গ্রেপ্তারের পর সিটিটিসি জানায়, মেজর জিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে জঙ্গি ছিনতাই পরিকল্পনার প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে গ্রেপ্তার মেহেদী হাসান অমি ওরফে রাফি। মেহেদী আদালতে মামলার নিয়মিত হাজিরা দেয়ার সময় কারাগারে থাকা আসামিদের ছিনতাইয়ের পরিকল্পনার কথা জানায়। এরই ধারাবাহিকতায় পরিকল্পনা মোতাবেক জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটে।
ছিনতাই হওয়া জঙ্গি আবু সিদ্দিক সোহেলের স্ত্রী ফাতিমা তাসনিম শিখাকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাকে গ্রেপ্তারের পর সিটিটিসি প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান জানান, সোহেলের স্ত্রী শিখাকে গ্রেপ্তারের পর ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা ও পালিয়ে যাওয়ার বিস্তারিত তথ্য জানা যায়। ৬ মাস ধরে ছিনতাই পরিকল্পনা করে জঙ্গিরা। আদালত থেকে পালানোর পরে দুই জঙ্গি সদরঘাট হয়ে একটি শেল্টার হাউসে অবস্থান নেন। সেখান থেকে তারা অন্য জায়গায় পালিয়ে যান। আর আদালত চত্বর থেকে শিখাসহ অন্যরা বিকল্প রাস্তা দিয়ে এলাকা ছাড়েন। আদালত থেকে পালানোর পরও শিখার নারায়ণগঞ্জের বাসায় সোহেলের যাতায়াত ছিল। তিনি ওই বাসায় দুবার গিয়েছিলেন।
সুত্র” ভোরের কাগজ