জঙ্গি অর্থায়ন কোনোভাবেই যেন থামানো যাচ্ছে না। এতে বেশি প্রভাব ফেলছে বিদেশ থেকে আসা মোটা অঙ্কের অর্থ। ব্যাংকিং, নন ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রায় নিয়মিতই আসছে এসব অর্থ। গোয়েন্দা চোখ ফাঁকি দিয়ে এসব অর্থেই গজাচ্ছে নতুন নতুন জঙ্গি সংগঠন। বিশেষ করে ‘ডার্কওয়েব’ ব্যবহার করে ক্রিপটোকারেন্সির মাধ্যমে জঙ্গিদের অর্থ সংগ্রহ করার কিছু তথ্য রীতিমতো গোলকধাঁধায় ফেলছে গোয়েন্দাদের। মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) মাধ্যমে জঙ্গিবাদে অর্থ লেনদেনের অনেক প্রমাণও পেয়েছেন তারা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২২ সালে যুক্তরাজ্য থেকে জঙ্গিদের কাছে বিপুল পরিমাণ অর্থ এসেছে। একই বছরে বড় অঙ্কের অর্থ এসেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকেও নানা অসিলায় অর্থ আসছে জঙ্গিদের কাছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জঙ্গি সংগঠনগুলোতে ক্রিপটোকারেন্সির মাধ্যমে অর্থ আসার বিষয়টি কোনোভাবেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ জঙ্গিরা এখন অনেক বেশি স্মার্ট। ভুল ব্যাখ্যায় এবং আবেগের বশবর্তী হয়ে অনেক শিক্ষিত মাল্টি ট্যালেন্টেড যুবক এ পথে পা বাড়াচ্ছে। তবে অর্থায়ন ঠেকাতে আমাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’ সংগঠন পরিচালনায় অর্থের জোগান দেওয়া হয় মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে। সংগঠনটির অন্যতম সদস্য জামিল এক সময় ওমানে থাকতেন। তার সঙ্গে কাতার প্রবাসী রাশিদ আলীর পূর্বপরিচয় ছিল। সেই সূত্রে রাশিদের কাছ থেকে ৫০ শতক সরকারি খাসজমি কিনে সেখানে জঙ্গি আস্তানা করা হয়। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, অর্থপ্রবাহ না থাকলে কোনো সংগঠন চলতে পারে না। সে ক্ষেত্রে কেবল নিজেদের সংগ্রহ করা অর্থ দিয়ে জঙ্গি সংগঠনের কর্মকাণ্ড চালানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তবে বিদেশি অর্থায়ন বন্ধ করা না গেলে জঙ্গিবাদ কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না। এত অল্প সময়ে ‘জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ এবং ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’র মতো জঙ্গি সংগঠনের অস্তি¡ত্ব খুঁজে পাওয়া অনেক বেশি অ্যালার্মিং। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, গত চার মাসে ‘আনসার আল ইসলাম’ বা আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) ও জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) নতুন ও পুরনো অংশের কাছে হুন্ডির মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা এসেছে।
সম্প্রতি গ্রেফতার জঙ্গি এবং প্রযুক্তিগত তথ্য বিশ্লেষণ করে তারা এমনটাই জানতে পেরেছেন। তবে এখন পর্যন্ত অর্থ পাঠানো ব্যক্তি কিংবা গ্রহণকারী কোনো পক্ষেরই তথ্য পুরোপুরি বের করতে পারেননি তারা। জুলাই মাসের মাঝামাঝি মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ থেকে ভারত হয়ে বাংলাদেশে আসা ১ কোটি ২০ লাখ টাকা গ্রহণকারী একাধিক জঙ্গি নেতাকে খোঁজা হচ্ছে। এর বাইরে নন-ব্যাংকিং চ্যানেলেও সম্প্রতি চার দফায় কয়েক কোটি টাকা এসেছে জঙ্গিদের কাছে। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জঙ্গিবাদে অর্থের লেনদেন হয়েছে এমন বেশ কিছু অ্যাকাউন্ট নম্বর আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকে দিয়েছি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেগুলো জব্দ করেছে। আবার হিন্দাল শারক্বীয়া এবং অনলাইন জুয়ার অর্থ লেনদেনে তিনটি ‘এমএফএস’-এর অনেকগুলো মোবাইল নম্বর আমরা শনাক্ত করেছি। সেগুলোও কর্তৃপক্ষকে দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে সরাসরি ক্যাশ লেনদেনও হয়ে থাকে জঙ্গি অর্থায়নের ক্ষেত্রে। অনেককে ভুল বুঝিয়েও জঙ্গিরা অর্থ আদায় করে থাকে। তিনি আরও বলেন, দেশ-বিদেশের যেসব অ্যাকাউন্ট এবং ‘এমএফএস’-এর মাধ্যমে জঙ্গি অর্থায়ন হয় সেগুলোর ওপর আরও কঠোর মনিটরিং হওয়া উচিত।
বিদেশের ক্ষেত্রে প্রয়োজনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে অবহিত করে অর্থায়ন বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। জঙ্গিবাদ নিয়ে কাজ করা সিটিটিসির জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা জানান, জঙ্গিবাদে অর্থের একটি বড় অংশ প্রথমে মালয়েশিয়া থেকে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে পাঠানো হয়। সেখান থেকে সোনায় রূপান্তর করে ভারতে পাঠানো হয়। সেখান থেকে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ আসে জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের কাছে। এ ছাড়া পুরনো জেএমবির কার্যক্রম গতিশীল করার জন্যও একই কৌশলে টাকা আসছে বলে তারা মনে করছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রগুলো বলছে, দেশের বাইরের জঙ্গি সংগঠনগুলোর শীর্ষ স্থানীয়রা নতুন জঙ্গি সংগঠনের নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছে। তাদের অর্থে দেশে নতুন নামে জঙ্গি সংগঠন সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। নতুন জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গে পুরনো জেএমবি, আনসার আল ইসলাম ও হুজির সম্পর্ক থাকতে পারে। আগে থেকেই জঙ্গি অর্থায়নের মাধ্যম হিসেবে হুন্ডি ব্যবহার করত জঙ্গিরা, তবে এখন তারা ভার্চুয়াল কারেন্সিতে ঝুঁকছে বেশি। ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা আদান-প্রদান করছে আইএস ও আল-কায়েদাপন্থিসহ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন। অস্ত্র কেনা, বিস্ফোরক তৈরিসহ সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা, জঙ্গি ভাবধারা প্রচারের জন্যও ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে আসা টাকা চলে যাচ্ছে বিভিন্ন মডিউলে। এসব অর্থ আসছে যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক, মধ্যপ্রাচ্যের সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ কয়েকটি দেশ থেকে।
এ তথ্য পাওয়ার পর থেকে জঙ্গিদের আর্থিক লেনদেন বন্ধে নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’ নামে নতুন জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পাওয়ার পর এ পর্যন্ত সংগঠনটির ৩৭ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে সিটিটিসি। এর মধ্যে এক চিকিৎসক ও তার স্ত্রী রয়েছেন। বেশ কয়েকজন নারীও রয়েছেন। পক্ষাঘাতগ্রস্ত নাটোরের জুয়েল মাহমুদই (৩০) ‘কথিত ইমাম মাহমুদ’ কাফেলার দলনেতা, দাবি করেছে চিকিৎসক সোহেল তানজীম। চীনের ইয়াংজু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক করা রাহাত মণ্ডল ও মেহেদী হাসান আর্থিক বিষয়টি সমন্বয় করতেন। ডা. সোহেল তানজীম মাসে ১ লাখ টাকা নিতেন সংগঠনে সময় দেওয়ায় বেতন হিসেবে। একইভাবে জুয়েল মাহমুদসহ অন্যরা সংগঠনে নেতৃত্ব দেওয়ায় মাসিক পারিশ্রমিক নিতেন, জানিয়েছেন তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা। একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ভার্চুয়াল কারেন্সিতে লেনদেনের তথ্য শনাক্তে অনেক ক্ষেত্রেই সক্ষম নয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ ছাড়া দেশে অসংখ্য অননুমোদিত মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ী রয়েছেন, যারা প্রতিনিয়ত অর্থের লেনদেন করেন কোনো তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই। এতে সন্দেহভাজনদের শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য। তারা আরও বলছেন, ভার্চুয়াল কারেন্সি বেচাকেনা চলছে ডার্কওয়েবে। জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্যদের হয়ে কাজ করছে অনেক ক্রিপ্টো এজেন্ট। অ্যাকাউন্টগুলো রয়েছে তাদের নামে। টাকা সংগ্রহের পর পাঠিয়ে দেওয়া হয় ওই এজেন্টদের কাছে। তা দিয়ে ক্রিপ্টোকারেন্সি কেনার পর অনলাইনে বিদেশে বা দেশের কোনো এজেন্টের কাছে পাঠানো হয়।
এরপর তা ভাঙিয়ে টাকা, রুপি বা ডলার করা হয়। এসব অর্থ তাদের হাত ঘুরে পৌঁছে যায় জঙ্গিদের তহবিল দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির কাছে। এজেন্টদের খোলা অ্যাকাউন্টগুলো নাম-পরিচয়হীন। কেবল নিউমেরিক্যাল নম্বর থাকছে, যে কারণে অ্যাকাউন্টগুলো কার সেটি জানা যাচ্ছে না। দেশি ও বিদেশি অ্যাকাউন্টের মধ্যে পার্থক্য করা যাচ্ছে না। গোটা কারবার ডার্কওয়েবে চলায় কোনো ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট থাকছে না। তাই কে টাকা পাঠাল, আর তা কোথায় গেল, তার হদিস পাচ্ছেন না তদন্তকারীরা।
সুত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন