সন্ত্রাসবাদ বিশ্বের প্রাচীনতম সমস্যার একটি। কালের পরিক্রমায় এটি বিভিন্ন সময়ে নিজের রূপ বদলে ফিরে এসেছে নতুন আঙ্গিকে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক, মতাদর্শগত বা ধর্মীয় উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য সহিংসতা বা সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে জঙ্গিবাদ বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার জন্য ক্রমাগত বৈশ্বিক উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান সময়ের সন্ত্রাসবাদ মূলত ৯/১১ ও আরব বসন্তপরবর্তী ঘটনা। সন্ত্রাসবাদ এ দেশের সৃষ্ট কোনো উপাদেয় না হলেও বিশ্বায়নের উত্তরাধিকারসূত্রে বাংলাদেশ এটি লাভ করেছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে র্যাব তার ম্যান্ডেটের আলোকে বাংলাদেশে জঙ্গি দমনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। এ দেশের প্রথম প্রজন্মের জঙ্গি গোষ্ঠিগুলোর শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে হাল আমলের নিষিদ্ধ হওয়া জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার আমিরসহ শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার করে এসব জঙ্গিগোষ্ঠীর নেটওয়ার্ক ভেঙে দেয় র্যাব। হুজিবির মুফতি হান্নান, জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলাভাইসহ অন্যান্য শীর্ষ নেতাকে গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার অপারেশনাল কমান্ডার মুফতি মঈন উদ্দিন ওরফে আবু জান্দাল এবং ২০০৫ সালে সিরিজ বোমা হামলায় ব্যবহৃত বোমাগুলোর প্রস্তুতকারক জাহিদুল ইসলাম ওরফে বোমারু মিজানকেও গ্রেপ্তার করে র্যাব। বিগত দশকে টার্গেট কিলিং-এর মাধ্যমে ১৩ জন মুক্তমনা ব্লগার ও লেখককে হত্যার মধ্য দিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করা আনসার আল ইসলামের আধ্যাত্মিক নেতা মাহমুদ হাসান গুনবিসহ অন্যান্য শীর্ষ নেতাও র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়। এর পর দীর্ঘ সময় দেশে তেমন জঙ্গি হামলা সংঘটিত না হলেও ২০১৬ সালে হলি আর্টিসান হামলার মাধ্যমে পুনরায় জঙ্গি সংগঠনের অস্তিত্ব ফুটে ওঠে। হলি আর্টিসানে জঙ্গি হামলায় প্রাথমিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যৌথ বাহিনীর সঙ্গে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে মূল অভিযান তৈরির ক্ষেত্র প্রস্তুত করে র্যাব। পরবর্তী সময়ে হলি আর্টিসান হামলার মূল পরিকল্পনাকারী জেএমবিপ্রধান সারোয়ার জাহানকে আশুলিয়ায়; হলি আর্টিসান হামলার অর্থ, অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহকারী জেএমবির শূরা সদস্য মামুনুর রশীদ রিপনকে গাজীপুরে; হলি আর্টিসান মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি জেএমবির শীর্ষ নেতা শরিফুল ইসলাম খালিদসহ অন্যদের বিরুদ্ধে চাঁপাইনবাবগঞ্জে সফল অভিযান পরিচালনা করে। দেশব্যাপী বিভিন্ন স্থানে একের পর এক জঙ্গিবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে তাদের সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে দিয়ে বিপুল সংখ্যক জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় র্যাব।
মানুষ কেন জঙ্গিবাদে লিপ্ত হয়
বাংলাদেশে জঙ্গিবাদে জড়ানোর অন্যতম প্রধান কারণ আদর্শগত বা ধর্মীয় প্রত্যয়। জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে জড়ানো ব্যক্তিরা এমন চরমপন্থি গোষ্ঠীর প্রতি আকৃষ্ট হয়, যেগুলো তাদের মতাদর্শগত বা ধর্মীয় বিশ্বাস পূরণের পথের প্রতিশ্রুতি দেয়। এই বিশ্বাসগুলো তাদের সহিংসতাকে একটি পবিত্র বা নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে দেখতে সহায়তা করে। এটি অনেক ক্ষেত্রে লোভনীয় হতে পারে। এ ছাড়াও এই মতাদর্শ ধর্ম, জাতীয়তাবাদ বা রাজনৈতিক বিশ্বাসের মধ্যে নিহিত থাকতে পারে। যে ব্যক্তিরা বর্তমান আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর বিতৃষ্ণা বোধ করে, তারা জঙ্গিবাদী মতাদর্শের প্রতি বেশি সংবেদনশীল।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, কিছু ব্যক্তি মানসিক দুর্বলতার কারণে জঙ্গিবাদের প্রতি সংবেদনশীল হতে পারে। বন্ধুবান্ধব, পরিবারের সদস্য বা পরিচিতজন, যারা ইতোমধ্যে জঙ্গিবাদে জড়িত তারা মানসিকভাবে দুর্বল ব্যক্তিদের ওপর সহজেই প্রভাব বিস্তার করতে পারে। ব্যক্তিগত অভিযোগ এবং প্রতিশোধপরায়ণ ব্যক্তিদের তারা জঙ্গিবাদে জড়াতে প্ররোচিত করতে পারে। এ ছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে বা তাদের কোনো সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষতি, অবিচার বা সহিংসতার অভিজ্ঞতা মানুষকে জঙ্গিবাদের দিকে ঠেলে দিতে পারে, যা তাদের নিপীড়কদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় বলে তারা বিশ্বাস করে। র্যাডিক্যালাইজেশন প্রক্রিয়াটি অনেক সময় গোপনীয় সামাজিক নেটওয়ার্কগুলোর মধ্যে ঘটে, যেখানে এর ব্যবহারকারীরা জঙ্গিবাদের ধারণা প্রকাশ করে এবং বন্ধু, পরিবারের সদস্য বা ক্যারিশম্যাটিক নেতাদের দ্বারা জঙ্গিবাদে যোগদানের জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়। অনেক সময় আর্থসামাজিক কারণে মানুষ জঙ্গিবাদে জড়ায়। দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং মৌলিক সেবাগুলো লাভের অভাব মাঝেমধ্যে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে পারে, যেখানে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো আর্থিক সহায়তা এবং সামাজিক অবস্থানের প্রতিশ্রুতি দেয়। এটি অর্থনৈতিক কষ্টের সম্মুখীন ব্যক্তিবর্গের কাছে একটি আকর্ষণীয় প্রলোভন হিসেবে কাজ করে। এ ছাড়াও অনেকে রাজনৈতিক স্থিতাবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করার উপায় হিসেবে সহিংসতাকে বেছে নেয়।
কীভাবে ও কাদের বেছে নেয়
জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো নতুন সদস্য নিয়োগে বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করে থাকে। তারা প্রায়ই নতুন সদস্যদের নিয়োগে বিদ্যমান সামাজিক নেটওয়ার্কগুলোকে কাজে লাগায়। বন্ধুবান্ধব, পরিবারের সদস্য বা পরিচিতজন ও সমবয়সীদের আদর্শিক প্রবৃত্তির মাধ্যমে জঙ্গিবাদে যোগদানের জন্য প্রভাবিত করতে পারে। বর্তমানে ইন্টারনেট উগ্রপন্থি গোষ্ঠীগুলোর জন্য নতুন সদস্য নিয়োগ এবং তাদের উগ্রবাদী মনোভাবাপন্ন করার জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম, অনলাইন ফোরাম এবং এনক্রিপ্ট করা মেসেজিং অ্যাপগুলো জঙ্গিবাদের প্রচার ও সম্ভাব্য নিয়োগকারীদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের একটি বিশাল প্ল্যাটফর্ম। সেখানে তারা তাদের নিজস্ব ডিজাইনকৃত প্রোপাগান্ডা ও র্যাডিক্যালাইজেশন ম্যাটেরিয়াল-সমৃদ্ধ ভিডিও, প্যাম্ফ্লেট ও বিভিন্ন অনলাইন সামগ্রী প্রচার করে, যেগুলো জঙ্গিবাদের মতাদর্শ প্রচার করে। তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয়ে ভুল ব্যাখ্যা উপস্থাপনের মাধ্যমে সহিংসতাকে মহিমান্বিত এবং তাদের উদ্দেশ্যকে ন্যায্যতা দিয়ে তাদের মতাদর্শের প্রতি নতুন সদস্যদের আগ্রহী করে তোলে।
জঙ্গিগোষ্ঠী প্রায়ই সেসব দুর্বল ব্যক্তিকে টার্গেট করে, যাদের মধ্যে ব্যক্তিগত হীনম্মন্যতা, ট্রমা বা বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি রয়েছে, যা তাদের মূলধারার সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিদের তাদের আহ্বানের প্রতি আরও সংবেদনশীল করে তোলে। এ ছাড়াও জঙ্গিগোষ্ঠী তাদের সংগঠনে যোগদানের বিনিময়ে নিয়োগপ্রাপ্তদের প্রলুব্ধ করতে অর্থের প্রতিশ্রুতি, চাকরির সুযোগ বা তাদের পরিবারকে সহায়তা করার জন্য আর্থিক প্রণোদনা দেয়। কিছু ক্ষেত্রে যেসব অঞ্চলে জঙ্গিগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য নিয়ন্ত্রণ রয়েছে সেখানে প্রান্তিক বা সামাজিকভাবে দুর্বল ব্যক্তিদের জঙ্গিবাদে জড়াতে বাধ্য করা বা হুমকি দেওয়া হয়।
এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, কোনো অপরাধের ফলে কারাগারে গিয়ে অনেক কয়েদি জঙ্গিবাদী মতাদর্শের সংস্পর্শে এসে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয় ও সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে বিদ্যমান জঙ্গিদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে দেখা যায়।
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে সরকার, বিভিন্ন সম্প্রদায়, সুশীল সমাজসহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারকে নিয়ে একটি বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। জঙ্গিবাদ একটি আদর্শিক সমস্যা। তাই সরকার এবং বিভিন্ন সংস্থাকে জঙ্গিগোষ্ঠী দ্বারা প্রচারিত চরমপন্থি মতাদর্শকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য পাল্টা আখ্যান তৈরি করা উচিত। এই আখ্যানগুলোতে সহনশীলতা, সহমর্মিতা ও অহিংসার ওপর জোর দেওয়া উচিত। জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে শিক্ষা ও সচেতনমূলক কর্মসূচি বিশেষভাবে জরুরি। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সমালোচনামূলক চিন্তার বিকাশ, সহনশীলতার প্রচার এবং চরমপন্থি মতাদর্শ মোকাবিলায় ভূমিকা রাখতে পারে। সম্প্রদায়গুলোর সঙ্গে জড়িত হয়ে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন ধর্মীয় সংস্থা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে জঙ্গিবাদের ঝুঁকিতে থাকা শ্রেণিকে চিহ্নিত; তাদের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক তৈরি; তাদের বিভিন্ন অভিযোগের সমাধান মৌলবাদ প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে।
আজকের ডিজিটাল যুগে অনলাইন র্যাডিক্যালাইজেশন প্রতিরোধে প্রচেষ্টা গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম, সরকার এবং সুশীল সমাজকে উগ্রবাদী মতাদর্শ চ্যালেঞ্জ করে এমন অনলাইন পাল্টা বর্ণনা প্রচার করার সময় উগ্রবাদী বিষয়বস্তু নিরীক্ষণ এবং অপসারণ করতে সহযোগিতা করতে হবে।
জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে আর্থসামাজিক কারণগুলো মোকাবিলা করা অপরিহার্য। অর্থনৈতিক বিকল্প হিসেবে জঙ্গিবাদের আবেদন কমাতে সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিক্ষা এবং সামাজিক পরিষেবাগুলোতে সরকার ও এনজিওর বিনিয়োগ করা উচিত। জঙ্গিবাদের জড়িত ব্যক্তিদের জন্য পুনর্বাসন কর্মসূচি, মানসিক সহায়তা, শিক্ষা, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ এবং সমাজে পুনরায় আত্তীকরণের সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। এসব কার্যক্রমের পাশাপাশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে অবশ্যই জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, নজরদারি এবং প্রয়োজনে মৌলবাদে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করার মাধ্যমে এদের বিকাশ রোধ করতে হবে।
সুত্রঃ সমকাল