আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে দেশে সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। হরতাল-অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াওয়ের মতো সংঘাতময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো। আর এ সুযোগে জঙ্গি তৎপরতা বৃদ্ধির শঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা নতুন নতুন নামে সংগঠন খুলে তৎপর হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে অনলাইনে বিভিন্ন অ্যানক্রিপটেড অ্যাপসের মাধ্যমে সংগঠিত হচ্ছে তারা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজর এড়াতে উচ্চপ্রযুক্তির নতুন নতুন যোগাযোগ অ্যাপ তৈরি করেছে তারা।
দেশে নিষিদ্ধ ৯টি জঙ্গি সংগঠনের যে সব শীর্ষ নেতা বিগত সময়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন সম্প্রতি তাদের অনেকে জামিন পেয়ে কিংবা কারাভোগ করে মুক্ত হয়েছেন। তাদের নেতৃত্বেই জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। জঙ্গি দমনে কাজ করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
পুলিশের অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের (এটিইউ) পুলিশ সুপার (অপারেশন্স) মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন যুগান্তরকে বলেন, একটি রাষ্ট্রের সবচাইতে সেনসেটিভ (সংবেদনশীল) আয়োজন হচ্ছে নির্বাচন। তখন যত ধরনের অপশক্তি আছে সব জেগে উঠার একটি পাঁয়তারা করে। আমরা সাইবার প্যাট্রোলিং এবং ফিজিক্যাল প্যাট্রোলিংয়ের মাধ্যমে এ ব্যাপারে সক্রিয় আছি। এখন পর্যন্ত এটিইউর কাছে জঙ্গি হুমকির সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই বলে দাবি করেন এই কর্মকর্তা। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এখন পর্যন্ত দেশে ৯টি জঙ্গি সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া আইশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে নিষিদ্ধের প্রস্তাব করা হয়েছে নব্য জেএমবিকে। দেশে প্রথম নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন শাহাদাৎ-ই-আল হিকমা।
২০০৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি এ সংগঠনটি নিষিদ্ধ করে সরকার। পরে ২০০৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি নিষিদ্ধ করা হয় জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি) এবং জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)। একই বছরের ১৭ অক্টোবর নিষিদ্ধ করা হয় হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজিবি)। ২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর হিজবুত তাহরির (এইচটি); ২০১৫ সালের ২৫ মে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি), ২০১৭ সালের ৫ মার্চ ‘আনসার আল ইসলাম’ (এএআই); ২০১৯ সালের ৪ নভেম্বর আল্লাহর দল এবং সর্বশেষ চলতি বছরের ৯ আগস্ট জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া নিষিদ্ধ করা হয়।
এসব নিষিদ্ধ সংগঠনের সদস্যরাই বর্তমানে নতুন নতুন নামে জঙ্গি সংগঠন গড়ে তুলেছে। ১৪ সেপ্টেম্বর বাগেরহাটের রামপাল থেকে নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘তাওহীদুল উলূহিয়্যাহ’র প্রতিষ্ঠাতা জুয়েল মোল্লাকে গ্রেফতার করে পুলিশের এটিইউ। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সংগঠনটির সক্রিয় সদস্য রাহুলকে জয়পুরহাটের আক্কেলপুর থেকে, গাজিউল ইসলামকে রাজধানীর ভাসানটেক থেকে এবং বাঁধন হোসেনকে পল্লবী থেকে গ্রেফতার করা হয়।
এটিউইর অভিযানসংশ্লিষ্টরা জানান, গ্রেফতারকৃতরা ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করে উগ্রবাদী অডিও, ভিডিও আপলোড ও শেয়ার করে গণতন্ত্র উৎখাতের চেষ্টা ও দেশব্যাপী নাশকতার পরিকল্পনার জন্য সদস্য সংগ্রহ করে আসছিল। তারা নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন ‘আনসার আল ইসলাম’র সদস্য এবং একই মতাদর্শে বিশ্বাসী বেশকিছু সদস্যকে নিয়ে নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘তাওহীদুল উলূহিয়্যাহ’ গঠন করে।
এটিইউর সাইবার মনিটরিং সূত্র জানিয়েছে, দেশে জঙ্গি তৎপরতার শতভাগ এখন অনলাইনকেন্দ্রিক। নতুন নতুন নামে সংগঠন খুলে জঙ্গিরা অ্যাডভান্স টেকনোলজি এবং নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের হাইব্রিড মডেল ব্যবহার করায় তাদের অনেক তথ্যই পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষ করে হিজবুত তাহরির সদস্যরা বেশি সক্রিয়। গ্রেফতার ও নজরদারি এড়াতে তারা নতুন নামে সংগঠন করছে। যোগাযোগের জন্য এরা বেশি ব্যবহার করছে টেলিগ্রাম অ্যাপস। আর নতুন সদস্য সংগ্রহে ব্যবহার করছে সোশ্যাল মিডিয়া।
এটিইউর মিডিয়া শাখা থেকে জানা গেছে, চলতি বছরে এটিইউর ৫৮টি অভিযানে ১৩১ জঙ্গি গ্রেফতার হয়েছে। গ্রেফতার জঙ্গিদের একটি বড় অংশ এটিইউকে জানিয়েছে, তারা কোনো না কোনো সময় ইউটিউবে উগ্রবাদী বিভিন্ন ভিডিও কনটেন্ট দেখে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন।
২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট জঙ্গিরা দেশের ৬৩টি জেলায় একযোগে বোমা হামলা চালানোর মধ্য দিয়ে নিজেদের সংগঠিত হওয়ার বিষয়টি জানান দেয়। এর এক দশক পর ২০১৬ সালে বাংলাদেশে সবচেয়ে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে। রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় ২২ জন নিহত হন, যার ১৮ জনই বিদেশি নাগরিক। এ হামলার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে জঙ্গি তৎপরতা অনেকটা স্তিমিত হয়। তবে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া ও ইমাম মাহমুদের কাফেলা নামে নতুন দুটি জঙ্গি সংগঠন ফের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। পরে জামাতুল আনসার নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
পুরাতন নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনগুলোর মধ্যে যারা সক্রিয় কাজ করতে চায়, তারাই বিভিন্ন সময় একসঙ্গে বসে নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ায়’ যুক্ত হয়েছিল। পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) অতিরিক্ত উপকমিশনার আতিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ২০১৩-১৪ সালের দিকে জঙ্গিদের একটি বড় ধরনের উত্থান হয়েছিল বাংলাদেশে। পরবর্তীতে এসব জঙ্গি সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যাপক সংখ্যক সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। এদের একটি বড় অংশ গত দুই বছরে জামিন ও কারাভোগ করে বের হয়ে ফের তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে। এখন বাইরে যে জঙ্গি কার্যক্রম হচ্ছে সেখানে নেতৃত্ব দিচ্ছে তারাই। বিভিন্ন সময় জঙ্গিদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে এলেও তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারছে না। ফলে জেল থেকে বের হয়ে আবার জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছে তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, আমরা গ্রেফতার জঙ্গিদের ডি-রেডিকালাইজেশন (জঙ্গিবাদ থেকে বের করে আনা) প্রোগ্রামের আওতায় এনেছি। আমাদের এ প্রোগ্রাম চলমান আছে।
সুত্রঃ যুগান্তর