ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের সংঘাতের খবর শুনে বড় হয়েছি এবং ক্রমান্বয়ে বয়স্ক হচ্ছি। সংঘাত চলে, কিছু সময় থামে এবং আবার শুরু হয়। সর্বশেষ শুরু হলো ৬ অক্টোবর ২০২৩ এবং অদ্যাবধি চলমান আছে। হামাস ভালো করে জানে ইসরায়েলের কাছে অনেক ক্ষমতাসম্পন্ন প্রযুক্তি ও অস্ত্র আছে; কিন্তু তা সত্ত্বেও কেন হামলার সূত্রপাত করল? বিশ্লেষণ করলে বুঝা যায় নানাবিধ কারণে হামাস এ সংঘাতের সূচনা করেছে। ইসরায়েল ক্রমান্বয়ে ফিলিস্তিনের ভূখন্ড দখল করে চলেছে এবং কাঁটাতারের বেড়ার মাধ্যমে ফিলিস্তিনের লোকজনকে একটি তাঁবুর মধ্যে বসবাস করার পরিবেশ তৈরি করছে। ইসরায়েল ইতোমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখছে। জর্ডান, মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং এমনকি সৌদি আরবের সঙ্গে সমঝোতা হচ্ছে। এ সমস্ত দেশের সঙ্গে যদি ইসরায়েলের স্বাভাবিক বা কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়, তাহলে ফিলিস্তিনের বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যেতে পারে। হামাসের কৌশল হচ্ছে সংঘাত বেধে গেলে ফিলিস্তিনে হতাহতের সংখ্যা বাড়বে এবং আরব জাহানে আমজনতার ক্ষোভ বৃদ্ধি পাবে এবং উক্ত দেশের সরকার ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিক বা কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে বিরত থাকবে।
এ সংঘাতের পটভূমি হচ্ছে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ হতে। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহিত রেজুলেশন ১৮১, যেটি বিভক্তিকরণ পরিকল্পনা (পার্টিশনপ্ল্যান) যাবৎকালীন ব্রিটিশ সরকার আরবে ইহুদিদের বসবাসের জন্য আলাদা রাষ্ট্র চিন্তা করেছিল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৪ মে ১৯৪৮ সালেই ইসরায়েল প্রতিষ্ঠিত হয় এবং প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ সংঘটিত এবং ১৯৪৯ সালে যুদ্ধের সমাপ্তি হয়। যুদ্ধের ফলাফল সাত লাখ পঞ্চাশ হাজার ফিলিস্তিন বাস্তুচ্যুত এবং ফিলিস্তিনকে তিনটি অংশে ভাগ করা হয়; ইসরায়েল রাষ্ট্র, পশ্চিমতীর (জর্ডান নদীর) এবং গাজা উপত্যকা।
৭ অক্টোবর ২০২৩ ইসরায়েল হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। গাজা উপত্যকায় সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে তীব্র খাবার সংকট দেখা দিয়েছে। পরবর্তীতে অবশ্য কিছু দাতব্য সংস্থার প্রচেষ্টায় কিছু ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশ করেছে; যা চাহিদার তুলনায় অতিনগণ্য। ইসরায়েলের হামলায় এখন পর্যন্ত ফিলিস্তিনে পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন। এ যুদ্ধে গাজা উপত্যকা শিশু মৃত্যুর নগরীতে পরিণত হয়েছে। ইউনিসেফ জানাচ্ছে এখন পর্যন্ত ২৩৬০ জন শিশুর মৃত্যু হয়েছে এবং আহত হয়েছে ৫৩৬৪ জন। প্রতিদিন গড়ে ৪০০ বা তারও বেশি শিশু হয় আক্রান্ত হচ্ছে নয়তো মৃত্যুবরণ করছে। যুদ্ধের কারণে শিশুরা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শিশুদের হত্যা, বাসস্থান ধসে পড়া, চিকিৎসা ও খাদ্যের অভাব শিশুদের অধিকারকে ক্ষুণ্ন করছে।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পরপর দুটি রেজুলেশন উপস্থাপন করা হলেও ভেটোর কারণে তা স্থগিত করা হয়েছে। একপক্ষ অপরপক্ষকে দোষারোপ করছে। কোনপক্ষই এখনই যুদ্ধ থামার কথা বলছে না। গাজায় যা হচ্ছে এটা যুদ্ধ নয়- এটা হলো গণহত্যা, যাতে প্রায় দুই হাজারের বেশি শিশু নিহত হয়েছে। এই যুদ্ধে তাদের কোন ভূমিকা নেই, তারা ভুক্তভোগী
বিবিসির সম্প্রতি একটি ভিডিও ডকুমেন্টরি দেখলাম। গাজার এক পরিবারের গল্প তুলে ধরেছে। পরিবারের দম্পতির এক কন্যাসন্তান ছিল। বয়স তিন বছর হবে। দীর্ঘ ১২ বছর পর একমাত্র কন্যাসন্তানের জন্ম হওয়ায় পরিবারে অনেক আনন্দ ছিল। বাবা পেশায় একজন স্থানীয় ফটোগ্রাফার। যুদ্ধ শুরু হওয়ায় পরিবারকে নিরাপদ স্থানে রেখে তিনি যুদ্ধকালীন বিভিন্ন ছবি তোলার কাজ করছিলেন। যুদ্ধের পঞ্চম দিনে খবর পেলেন পরিবারের সবার সঙ্গে একমাত্র কন্যাসন্তানও নিহত হয়েছে। তিনি আক্ষেপ করে বলছেন- ইসরায়েল শুধু হামাসের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করে নাই, ফিলিস্তিন জনগণের সঙ্গেও যুদ্ধ করছে।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পরপর দুটি রেজুলেশন উপস্থাপন করা হলেও ভেটোর কারণে তা স্থগিত করা হয়েছে। একপক্ষ অপরপক্ষকে দোষারোপ করছে। কোনপক্ষই এখনই যুদ্ধ থামার কথা বলছে না। গাজায় যা হচ্ছে এটা যুদ্ধ নয়। এটা হলো গণহত্যা, যাতে প্রায় দুই হাজারের বেশি শিশু নিহত হয়েছে। এই যুদ্ধে তাদের কোন ভূমিকা নেই, তারা ভুক্তভোগী।
এই যুদ্ধে আমাদের একটাই চাওয়া, এখনই যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। সংলাপের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান বের করতে হবে। শক্তিশালী বোমা দিয়ে মানুষ যা করতে পারে তার চেয়ে ঢের বেশি কিছু করার সামর্থ্য রাখে কার্যকরী সংলাপের শক্তি। আসুন আমরা শান্তির পক্ষে কথা বলি। এ পৃথিবীতে সবারই শান্তি ও মর্যাদা নিয়ে বসবাসের অধিকার আছে।
সুত্রঃ দৈনিক সংবাদ