দুই জঙ্গি মইনুল হাসান শামীম ও আবু ছিদ্দিক সোহেল
ঢাকার নিম্ন আদালত প্রাঙ্গণ থেকে পুলিশের চোখে পিপার স্প্রে মেরে ২০২২ সালের ২০ নভেম্বর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নিয়েছিল অপর জঙ্গিরা। ছিনিয়ে নেওয়া ওই দুজন ছিল প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের সদস্য মইনুল হাসান শামীম ও আবু সিদ্দিক সোহেল। ওই ঘটনায় ২০ জনকে আসামি করে মামলা করেন পুলিশ পরিদর্শক জুলহাস উদ্দিন আকন্দ। কিন্তু গত এক বছরেও তাদের গ্রেফতার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
ঘটনার ঠিক এক বছরের মাথায় গত ২০ নভেম্বর (২০২৩) ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের সামনে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ওইদিন রাতেই কোতোয়ালি থানার সাব-ইন্সপেক্টর মুহাম্মদ কামরুল হোসেন বাদী হয়ে অজ্ঞানতামাদের আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন। তবে আদালতের সিসিটিভি ফুটেজে আসামিদের শনাক্ত করে একজনকে আটক করা হলেও আরেকজন পলাতক রয়েছে।
জঙ্গি ছিনতাইয়ের মামলাটি তদন্ত করছে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। এখনও পর্যন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ১১ দফা সময় নিয়েছে তদন্ত সংস্থা। সর্বশেষ গত ১৪ নভেম্বর মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দিন ধার্য ছিল। তবে ওই দিন সিটিটিসি প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি। এজন্য ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ফারাহ দিবা ছন্দার আদালত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ১৭ ডিসেম্বর তারিখ নির্ধারণ করেন।
অপরদিকে আদালতের সামনে বিস্ফোরণের মামলাটি তদন্ত করছেন কোতোয়ালি থানার সাব-ইন্সপেক্টর বিল্লাল হোসেন জনি। সর্বশেষ গত ৫ ডিসেম্বর মামলাটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ ধার্য জন্য ছিল। তবে ওই দিন প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি পুলিশ। এজন্য ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ফারাহ দিবা ছন্দার আদালত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ১১ জানুয়ারি তারিখ ধার্য করেন।
আদালতপাড়ায় আসামি ছিনতাই ও বিস্ফোরণের মতো ঘটনাকে ঝুঁকির দৃষ্টিতে দেখছেন বিচারক, বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীরা। আইনজীবীরা বলছেন, বিপদে পড়লে আদালতের কাছে আশ্রয় নেন বিচারপ্রার্থীরা। তবে সেই আদালতই এখন বিপদের ঝুঁকিতে রয়েছে। আদালতে যখন কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে, তখন নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। কিছুদিন পর নিরাপত্তা ব্যবস্থা আবারও ঢিলে হয়ে যায়। ফলে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা থাকে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকার ১০ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আজাদ রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আদালত একটি স্পর্শকাতর জায়গা। আদালতের নিরাপত্তার বিষয়টি অবশ্যই পুলিশ-প্রশাসনকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। প্রতিদিন ঢাকার জজ কোর্টে লাখ লাখ মানুষের আনাগোনা থাকে। কে ভালো, কে খারাপ, কার মনের ভেতরে কী আছে, মানুষ দেখে তা বোঝা কঠিন। আসামি ছিনতাই ও বিস্ফোরণের মতো ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সেই বিষয়ে পুলিশ ও প্রশাসনের উচিত আরও কঠোর অবস্থানে থাকা।’
গত ৫ বছর ধরে ঢাকার জজ কোর্টে নিয়মিত মাদক মামলায় হাজিরা দিয়ে আসছেন আওলাদ হোসেন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, আগে কোর্টে আসতে খুব একটা ভয় পেতাম না। তবে কয়েক বছর ধরে আদালতপাড়ায় আসতে ভয় কাজ করছে। আদালতের মতো জায়গায় যদি আসামি ছিনতাই, ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে— তাহলে নিরাপদ স্থান কোনটি? ককটেল বিস্ফোরণের পর মনে হচ্ছে, আদালতপাড়ায় আসাটাও জীবনের জন্য ঝুঁকির।
২০২২ সালের ২০ নভেম্বর মোহাম্মদপুর থানায় দায়ের করা সন্ত্রাসবিরোধী আইনের একটি মামলা ঢাকার সন্ত্রাস বিরোধ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমানের আদালতে চার্জ শুনানির জন্য ছিল। মামলায় ২০ আসামির মধ্যে দুই আসামি জামিনে ছিলেন। তারা আদালতে হাজির হন। অপর ৬ আসামি আগে থেকেই পলাতক ছিল। ১২ আসামিকে কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়। ওইদিন ২০ আসামির বিরুদ্ধে চার্জগঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। এরপর দুপুর সোয়া ১২টার দিকে আসামিদের আদালত থেকে ঢাকার সিএমএম আদালতের হাজতখানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের মেইন গেটে আসলে হঠাৎ করে কয়েকজন দুর্বৃত্ত পুলিশের চোখে পিপার স্প্রে ছেড়ে দিয়ে দুই আসামিকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়।
ওই মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা সিটিটিসির পুলিশ পরিদর্শক আজিজ আহমেদ জানান, মামলাটির তদন্ত চলছে। ইতোমধ্যে এ ঘটনায় ২০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের মধ্যে দুজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে। ছিনিয়ে নেওয়া মূল দুই আসামি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আবু সিদ্দিক সোহেল ও মইনুল হাসান শামীমকে গ্রেফতারে অভিযান চলছে। তাদের গ্রেফতারে এ পর্যন্ত সারা দেশে ১৮/১৯ বার অভিযান চালানো হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘মামলার তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। ওই দুই মূল আসামি ধরা পড়লেই আদালতে চার্জশিট জমা দেবো।’
এদিকে আদালত প্রাঙ্গণে ককটেল বিস্ফোরণের মামলায় চলতি বছরের ২৬ নভেম্বর হাফসা আক্তার পুতুল নামে এক আসামিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরদিন ২৭ নভেম্বর ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আসামির তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। ৩০ নভেম্বর হাফসা আক্তার পুতুল আদালত প্রাঙ্গণে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনার দায় স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। বর্তমানে হাফসা কারাগারে রয়েছে।
ককটেল বিস্ফোরণের মামলার এজাহারে বলা হয়, গত ২০ নভেম্বর বিকাল ৩টা ৫২ মিনিটে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় অজ্ঞাত পরিচয় নাশকতাকারীরা। উপস্থিত আইনজীবীদের ও আদালতে আসা বিচারপ্রার্থীদের জীবন ও সম্পত্তি বিপন্ন অথবা গুরুতর ক্ষতিসাধনের লক্ষ্যে ককটেল বিস্ফোরণ করে তারা। এতে আদালতে আসা বিচারপ্রার্থীসহ বিভিন্ন লোকজন আতঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়াসহ আদালতের বিচার কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়।
সিসিটিভির ফুটেজে দেখা যায়, বোরকা পরিহিত এক নারী ও সঙ্গে থাকা এক পুরুষ মহানগর দায়রা জজ আদালতের চারতলা থেকে ককটেল সদৃশ বস্তু নিচে ফেলে। এ সময় তাদের সঙ্গে একটি শিশুও ছিল। এরপর তারা দ্রুত আদালত চত্বর থেকে চলে যায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা কোতোয়ালি থানার সাব-ইন্সপেক্টর বিল্লাল হোসেন জনি বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, এখনও পর্যন্ত একজন আসামিকে আমরা গ্রেফতার করতে পেরেছি। গ্রেফতারকৃত আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে। মামলাটির তদন্ত চলমান রয়েছে। আশা করি, খুব শিগগিরই ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্য আসামিদের গ্রেফতার করতে পারবো।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের হাজতখানার ইনসপেক্টর ফারুক জানান, আদালতের নিরাপত্তার বিষয়টি আমাদের হাতে নেই। এটা সম্পূর্ণ রাজধানীর কোতোয়ালি থানার পুলিশ কর্মকর্তাদের হাতে। আমাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও তাদের হাতে ন্যস্ত রয়েছে।
সুত্রঃ বাংলা ট্রিবিউন