এ দেশে বহুল প্রচারিত প্রতিশ্রুতি ও আহ্বান হলো—নারী নির্যাতন বন্ধ করতে হবে; নারী নির্যাতন বন্ধে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে ইত্যাদি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে—প্রতি বছর নারী নির্যাতন আগের বছরকে ছাড়িয়ে যায়। এ বছরও তার ব্যতিক্রম নয়। এ দেশে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আইন থাকলেও সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। বছরজুড়ে নানা আঙ্গিকে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার কিছু গণমাধ্যমে আসছে। অনেক ঘটনাই থেকে যাচ্ছে আড়ালে।
বিগত বছরের মতো এ বছরও ব্যতিক্রম কিছু ঘটেনি। বছরের প্রায় প্রতিটি দিন কোনো না কোনো জায়গায় নারীরা নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এ বছরও রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার নারীর জন্য ফাঁপা বুলি উচ্চারণ করে গেছে। বছরজুড়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছে নারী নির্যাতনের খবর। এসব ঘটনা সমাজ, রাষ্ট্রকে স্পর্শ করে না। তাই বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে অপরাধীরা বুক ফুলিয়ে ভুক্তভোগীর সামনে হেঁটে বেড়ায়।
বছরের শুরুতেই; মানে জানুয়ারিতে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, চট্টগ্রাম মহানগরীর কাপাসগোলা সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রীদের যৌন নিপীড়নের ঘটনা। এ ছাড়া ফেব্রুয়ারিতে কুষ্টিয়া জেলার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি ও তার সহযোগীরা নবীন শিক্ষার্থীকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে এবং সেই নির্যাতনের ভিডিও ধারণ করে। মে মাসে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছাত্রী হলে এক আবাসিক শিক্ষার্থীকে তিন ঘণ্টা আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়।
এই বছর বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে জানা যায়, বিভিন্ন স্থানে প্রকাশ্যে গৃহবধূর চুল কর্তন, নারীকে গাছের সঙ্গে বেঁধে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করা হয়েছে। যেমনটি ঘটেছে গোপালগঞ্জ জেলা বাঘঝাপা গ্রামে, পটুয়াখালী জেলার দুমকি উপজেলাসহ আরও অনেক জায়গায়। এ বছরের রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গৃহবধূর শরীরে কেরোসিন, পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া,যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন, বেআইনি সালিশে নারীকে বর্বরভাবে বেত্রাঘাত ও পাথর নিক্ষেপ, স্কুলছাত্রীকে বখাটে কর্তৃক কুপিয়ে হত্যা, গৃহশিক্ষক কর্তৃক কলেজছাত্রীকে কুপিয়ে হত্যা, গৃহবধূকে হাত-পা বেঁধে ঘরে আটকে পুড়িয়ে হত্যা, মা ও মেয়েকে শ্বাসরোধ করে হত্যা, স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা, ধর্ষণের পর পুড়িয়ে হত্যা ও হত্যাচেষ্টার ঘটনা ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়।
দেশে নারী নির্যাতন এখন এতটাই নৈমত্তিক হয়ে গেছে যে, এর ভয়াবহতার মাত্রা বেশি না হলে তা সহজে আলোচনায় আসে না। সুধীজনেরাও আর ফিরে তাকান না।
মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) দেওয়া নভেম্বর মাসের মানবাধিকার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চলতি বছর আইন ও বিচার বহির্ভূত সালিশে নারীকে শাস্তি দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে ৪৪টি। আইন ও বিচার বহির্ভূত সালিশে শাস্তি দেওয়ার ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৩টি ধর্ষণের, ১১টি ধর্ষণচেষ্টার ও ৫টি বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের ঘটনা। এ ছাড়া হিল্লা বিয়ের সিদ্ধান্ত না মানায় একঘরে করা ১টি, চরিত্রহীন অপবাদ ২টি, প্রেমের কারণে সালিশ ১টি, যৌন হয়রানি ২টি, চুরি ২টি, সামাজিক প্রথা না মানায় একঘরে ২টি, পারিবারিক বিরোধ ২টি, হত্যা ২টি, ধর্ষণের অভিযুক্তের সাথে বিয়ের ১টি সালিশের ঘটনা ঘটেছে।
এসব ঘটনায় অনেক ক্ষেত্রেই প্রশাসনের ভূমিকা ছিল নির্লিপ্ত। শেষ পর্যন্ত অনেকেই সমাজে টিকে থাকতে না পেরে আত্মহত্যার দিকে পা বাড়ায়। চলতি বছর এমন ঘটনা ঘটেছে পাবনা, হবিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, যশোর, টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন জেলায়। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি বছরের (জানুয়ারি-নভেম্বর) আত্মহত্যা করেছেন ২২৫ জন।
শুধু কী আত্মহত্যা? এ বছর ঘরে ও ঘরের বাইরে হাজার রকমের নির্যাতনের শিকার হয়েছে নারীরা। ১২টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি বছরের (জানুয়ারি- নভেম্বর) ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪২৫ জন, দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার ১২২ জন, ধর্ষণের পর হত্যা ৭৬ জন, ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা ১৩ জন, ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ৯৪ জনকে, যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন ১৪৬ জন, উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছেন ৭৯ জন, অগ্নিদগ্ধের কারণে মৃত্যু হয়েছে ১৫ জনের, যৌতুকের কারণে হত্যার শিকার ৪৮ জন, শারীরিক নির্যাতনের শিকার ২২৩ জন, বিভিন্ন কারণে আত্মহত্যা ২২৫ জন, অপহরণের শিকার ১২৬ জন, বাল্যবিয়ের চেষ্টা ৪৪ জন, অপহরণের চেষ্টা ৩৩ জন, সাইবার ক্রাইমের শিকার ৪০ জন। সব মিলিয়ে এই সময়কালে মোট ২৫৭৫ নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
বছর জুড়ে নারী নির্যাতনের একটা ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই সামনে এসেছে নির্যাতনের অন্য এক ঘটনা। ধর্ষণের পাশাপাশি গণধর্ষণের ঘটনাও ছিল অনেক বেশি। প্রতিদিন খবরের পাতা খুললে দেখা গেছে যৌন হয়রানি ও সহিংসতা, ধর্ষণ ও হত্যা, পারিবারিক নির্যাতন, ধর্ষণের সময় ভিডিও ধারণ, পরবর্তীতে সেই ভিডিও অনলাইনে প্রচার, যৌতুকের জন্য নির্যাতনসহ নারীর প্রতি সহিংসতার বিভিন্ন ঘটনা।
বছরজুড়ে এত শত শত ঘটনার পর প্রশাসনের পক্ষ থেকে অনেক ক্ষেত্রেই তেমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বহু ক্ষেত্রে নারী নির্যাতনের অভিযোগে থানায় মামলা নেওয়া-না নেওয়ার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। প্রশাসনের নির্লিপ্ততা এবং ক্ষেত্রবিশেষে অভিযুক্তের পক্ষ নেওয়া আরও বেশি করে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে নারীদের মধ্যে। বিশেষত বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হওয়া নির্যাতনের কারণে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ নিরাপত্তাহীনতা ক্রমে বাড়ছে।
এখন চলছে ডিসেম্বর মাস। আর তিন মাস পর ৮ মার্চ পালন করা হবে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’। নারীর অর্জন ও অধিকার এ সবকিছু নিয়েই আলোচনা হবে সেদিন। এটা অনেকটা নিয়ম রক্ষার আলোচনা। আসবে নারী–পুরুষ সমতার কথাও। প্রতি বছরের মতোই নারীবান্ধব নীতি ও ব্যবস্থা গড়ার অঙ্গীকার আসবে সামনে, যেমনটা প্রতি বছরই আসে। কিন্তু বছর–বছর নারী নির্যাতনের ক্রমবর্ধমান পরিসংখ্যান থেকে মুক্তি মেলে না। এ চক্র থেকে শেষতক বের হওয়া হবে কি–না, তা শুধু সময় নয়, এর বিরুদ্ধে প্রশাসন ও সমাজের সক্রিয়তাই বলে দেবে।
সুত্রঃ ইন্ডেপেন্ট নিউজ