স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক যুগ্ম সচিব কামাল উদ্দিন আহমেদের বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করত ইতি আক্তার (১২) নামে এক শিশু। প্রায় দুই বছর আগে সেখানে তার অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে জানা যায়, মৃত্যুর আগে ধর্ষণের শিকার হয় শিশুটি। এতে নতুন মোড় নেয় তদন্ত। পুলিশের দীর্ঘ অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, গৃহকর্তাই তাকে ধর্ষণ করেন। এর পর ‘লজ্জায়-অপমানে’ সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
রাজধানীর রামপুরা থানার এ মামলায় সম্প্রতি কামাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
পিবিআইপ্রধান অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক বনজ কুমার মজুমদার সমকালকে বলেন, তদন্তকালে পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য-প্রমাণে কামাল উদ্দিনের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এ কারণে তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে তিনি পলাতক।
২০২২ সালের ২৯ জানুয়ারি বিকেলে রামপুরা থানা পুলিশ স্থানীয় বেটার লাইফ হাসপাতাল থেকে ইতির মরদেহ উদ্ধার করে। তখন গৃহকর্তার বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, পূর্ব হাজীপাড়ার ৩৯/৫/২ নম্বর বাসায় একটি কক্ষের জানালার গ্রিলের সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস দেয় শিশুটি। বাসার লোকজন তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় রামপুরা থানায় অস্বাভাবিক মৃত্যু (ইউডি) মামলা হয়।
তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানান, পূর্ব হাজীপাড়া এলাকার ওই বাসায় সাবেক যুগ্ম সচিব কামাল উদ্দিন, তাঁর স্ত্রী, ছেলে আইনজীবী রাজিন আহমেদ, পুত্রবধূ ও দুই গৃহকর্মী থাকতেন। ওই বাসার মাঝামাঝি করিডোরের মতো জায়গা রয়েছে। এর দুই পাশের ঘরগুলো বসবাস ও অন্যান্য কাজে ব্যবহার হয়। করিডোরের এক পাশে পরিবারের সদস্যরা থাকেন। অপর পাশে রাজিন আহমেদের চেম্বার, রান্নাঘর ও গৃহকর্মীদের থাকার ঘর। মৃত শিশুটির সঙ্গে ওই বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতেন রোকেয়া বেগম নামে এক নারী। তিনি পুলিশের কাছে ১৬১ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে জানিয়েছেন, ইতির মৃত্যুর আগের রাতে কামাল উদ্দিনকে গৃহকর্মীদের ঘরে ঢুকতে দেখেন তিনি। তখন তিনি এগিয়ে যান এবং দরজায় করাঘাত করেন। কামাল দরজা খুললে তিনি ওই ঘরে ঢোকার কারণ জানতে চান। উত্তরে কামাল জানান, তিনি শিশুদের খেলার বল নিতে এসেছেন। এর পর তিনি আবারও দরজা বন্ধ করে দেন। এর আনুমানিক আধাঘণ্টা পর তাঁকে ওই ঘর থেকে বের হতে দেখেন রোকেয়া। তিনি দ্রুত ঘরে ঢুকে ইতিকে কাঁদতে দেখেন। কান্নার কারণ জানতে চাইলে শিশুটি জানায়, গৃহকর্তা তার সঙ্গে ‘খারাপ কাজ’ করেছেন। সে আর কাউকে মুখ দেখাতে পারবে না এবং আত্মহত্যা করবে বলেও জানায়। পরদিনই তাকে গলায় ফাঁস দেওয়া অবস্থায় পাওয়া যায়।
শিশুটির মা ছারকিস আক্তারের অভিযোগ, ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে নানারকম চেষ্টা চালিয়েছেন গৃহকর্তার পরিবারের সদস্যরা। প্রথমে তারা ধর্ষণের কথা পুরোপুরি চেপে গেছেন। বিষয়টি জানার পর তিনি গত বছরের ২২ নভেম্বর রামপুরা থানায় মামলা করেন। তবে পুলিশ তদন্তে গড়িমসি করছিল। তাই পরে মামলাটি পিবিআইতে স্থানান্তর করা হয়।
তিনি এজাহারে উল্লেখ করেন, ঘটনার আগের দিন ইতি তাঁকে কল করে জানায়, সে আর ওই বাসায় কাজ করবে না। কারণ সেখানে তার ওপর নির্যাতন করা হয়। তখন তিনি মেয়েকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন বলে আশ্বস্ত করেন। এর পরদিনই তিনি মেয়ের মৃত্যুর খবর পান।
তিনি জানান, মৃতদেহ দেখে তাঁর সন্দেহ হয়েছিল, ছোট্ট মেয়েটির সঙ্গে খারাপ কিছু ঘটেছে। পরে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে তাঁর সন্দেহ সত্যি হয়। এ কারণে তিনি মামলায় গৃহকর্তা, তাঁর স্ত্রী, ছেলে, পুত্রবধূ, গৃহকর্মী এবং গাড়িচালকের বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনায় অভিযোগ আনেন।
তদন্ত সূত্র জানায়, ধর্ষণ নিশ্চিত হওয়ার পর খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, ঘটনার আগের চার দিন মেয়েটি বাসার বাইরে যায়নি। অর্থাৎ ধর্ষণ বাসার ভেতরেই হয়েছে। আবার ওই সময়কালে বাইরের কেউ বাসায় আসেননি। অর্থাৎ বাসার কেউ এতে জড়িত। সে ক্ষেত্রে গৃহকর্তা ও তাঁর ছেলেকে সন্দেহের তালিকায় রাখা হয়। প্রথমেই রাজিনকে সন্দেহ করা হলেও ঘটনার সঙ্গে তাঁর কোনো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। আবার কামাল উদ্দিনের বয়স বেশি হলেও তিনি শারীরিকভাবে সক্ষম। পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য-প্রমাণও তাঁর জড়িত থাকার পক্ষে সায় দেয়।
এদিকে কামাল উদ্দিন বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থান করছেন বলে একটি সূত্রে জানা গেছে। এর আগে তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তদন্তে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে।
সুত্রঃ সমকাল