প্রতীকী ছবি
সংসারে সচ্ছলতা এনে বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে গত বছরের ১৬ আগস্ট সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই গিয়েছিল মেয়েটি। সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে দুবাইয়ে তার মৃত্যু হয়। নভেম্বরের শেষ দিকে এই খবর জানতে পারে পরিবার। ডিসেম্বরে তার লাশ দেশে আসে।
পরিবারের ভাষ্য, মেয়েটির বয়স আসলে ১৭ বছর ছিল। তবে দালাল কাগজে-কলমে দেখিয়েছিল ২১ বছর। তাকে দুবাইয়ের একটি হাসপাতালে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এই কাজ তাকে দেওয়া হয়নি। তাকে দুবাইয়ে বিক্রি করে দেয় মানব পাচারকারীরা। সেখানে তাকে যৌন নির্যাতন করে মেরে ফেলা হয়েছে।
মেয়েটির লাশ গত বছরের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে দুবাই থেকে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসে। ডিসেম্বরের শেষ দিকে মেয়েটির বাবা ঢাকার মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে নালিশি মামলা করেন। মামলায় মানব পাচার ও খুনের অভিযোগ আনা হয়। মামলায় আসামি হিসেবে ফারজানা ও সোহাগী নামের দুই নারীর নাম উল্লেখ করা হয়।
ট্রাইব্যুনাল মেয়েটির বাবার অভিযোগ এজাহার হিসেবে রেকর্ড করার জন্য যাত্রাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে মামলাটি তদন্তের জন্য পুলিশের অপরাধ ও তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) নির্দেশ দেওয়া হয়।
যাত্রাবাড়ী থানার পরিদর্শক মো. আজহারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, লাশের সঙ্গে থাকা তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর দুবাইয়ে মেয়েটির মৃত্যু হয়। মৃত্যুর কারণ হিসেবে লেখা আছে ওপর থেকে পড়ে যাওয়া। দেশে মেয়েটির লাশের ময়নাতদন্ত হয়েছে। তবে প্রতিবেদন এখনো আসেনি। মৃত্যুর আগে মেয়েটি ধর্ষণের শিকার হয়েছিল কি না, তা জানার জন্য ফরেনসিক নমুনা সিআইডিতে পাঠানো হয়েছে।
‘বাবা, আমাকে নির্যাতন করা হচ্ছে’
পরিবার ও মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, মেয়েটির গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায়। তার বাবা পেশায় সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক, মা গৃহিণী। এই দম্পতির চার মেয়ে। বড় দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে। আর তৃতীয় মেয়েরই মৃত্যু হয়েছে দুবাইয়ে।
মেয়েটির বাবা প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ধারদেনা করে বড় দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। বাকি দুই মেয়ে তাঁদের সঙ্গে থাকত। সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালিয়ে তাঁর যে আয় হতো, তাতে সংসার চালাতে কষ্ট হতো। এ অবস্থায় তাঁর তৃতীয় মেয়েকে প্রতিবেশী সোহাগী টোপ দেন। বলেন, তাঁর বড় বোন ফারজানা দুবাইয়ে থাকেন। তিনি তাকে দুবাইয়ে নিয়ে যেতে পারবেন। এ জন্য টাকা লাগবে তিন লাখ। এই টাকা তাঁরা দেন।
মামলার এজাহারে বলা হয়, আসামি সোহাগী দালাল ধরে নারায়ণগঞ্জের ঠিকানায় মেয়েটির পাসপোর্ট করান। পরে ভ্রমণ ভিসায় মেয়েটিকে গত বছরের ১৬ আগস্ট দুবাই পাঠায়। দুবাই যাওয়ার কয়েক দিন পর মেয়েটি তাঁর বাবাকে ফোন দেয়। বাবাকে বলে, তাকে দুবাইয়ে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। নির্যাতনে সে গুরুতর অসুস্থ।
মেয়েটির বাবা প্রথম আলোকে বলেন, মেয়ে ফোনে তাঁকে বলেছিল, ‘বাবা, আমাকে নির্যাতন করা হচ্ছে।’ এরপর তিনি আর তাঁর মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি। গত ২৬ নভেম্বর তিনি জানতে পারেন, তাঁর মেয়ে আর বেঁচে নেই।
মেয়েটির বাবা বলেন, যোগাযোগে ব্যর্থ হয়ে যে নারীর (সোহাগী) মাধ্যমে মেয়ে দুবাই গিয়েছিল, তাঁর কাছে যান তিনি। পরে তাঁকে জানানো হয়, তাঁর মেয়ে আর বেঁচে নেই। কিন্তু কেন, কীভাবে মেয়ে মারা গেল, সে কথা তাঁকে বলা হয়নি।
মেয়েটির বাবা বলেন, মানব পাচারকারীরা তাঁর মেয়েকে দুবাই নিয়ে হত্যা করেছেন। মানব পাচারকারী-খুনিরা এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে। পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করছে না।
আসামি ফারজানা সম্প্রতি দেশে ফেরেন বলে জানা যায়। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মেয়েটিকে তিনি বলেছিলেন, দুবাইয়ে তাঁর মালিকের আচরণ ভালো। কিন্তু মালিক বিদেশি কর্মীদের দিয়ে খারাপ কাজ করান। তিনি মেয়েটিকে আসতে বারণ করেছিলেন। কিন্তু মেয়েটি তাঁকে না জানিয়েই দুবাই চলে আসে।
ফারজানা আরও বলেন, মেয়েটি দুবাই আসার একপর্যায়ে তার মা তাঁর (ফারজানা) বোন সোহাগীর কাছে গিয়ে বারবার বলেছিলেন, তিনি মেয়ের খোঁজ পাচ্ছেন না। তখন তিনি (ফারজানা) তাঁর মালিককে দিয়ে মেয়েটির খোঁজখবর নেন। পরে মালিক তাঁকে জানান, মেয়েটিকে নাকি মেরে ফেলা হয়েছে। এ খবর তিনি দেশে জানিয়ে দেন।
যাত্রাবাড়ী থানার পরিদর্শক আজহারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মামলাটি তদন্তের জন্য সিআইডিকে আদালত নির্দেশ দিলেও এখনো কোনো তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ হয়নি। তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগের পর তিনি মামলার নথিপত্র হস্তান্তর করবেন।
সুত্রঃ প্রথম আলো