গাজার মধ্যাঞ্চলের দেইর আল-বালাহ শহরের আল-আকসা হাসপাতালে একটি ইনকিউবেটরের ভেতর শুয়ে থাকা এক মাস বয়সী একটি মেয়ে শিশু কখনো তার পিতা-মাতার স্পর্শ পায়নি। অস্ত্রপচারের মাধ্যমে শিশুটিকে জন্ম দিয়েছিলেন তার মা হান্না। তারপরই ইসরায়েলের আকাশ হামলায় হান্না নিহত হন।
তিনি এমনকি নিজের মেয়ের জন্য একটি নাম পর্যন্ত রেখে যেতে পারেননি। যে কারণে হাসপাতালের চিকিৎসাকর্মীরা শিশুটিকে ‘ডটার অব হান্না আবু আমশা’ (হান্না আবু আমশার মেয়ে) বলে ডাকে। শিশুটির দেখাশুনা করেন নার্স ওয়ারদা আল-আওয়াওদা।
তিনি বিবিসিকে বলেন, “আমরা তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের ঠিকানা হারিয়ে ফেলেছি। তার কোনো স্বজনও এখন পর্যন্ত হাসপাতালে আসেনি। আমরা জানি না তার বাবার কি হয়েছে।”
গত বছর ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় অভিযান শুরু করেছে ইসরায়েল। যে অভিযোনে গাজার ২৩ লাখ মানুষের প্রায় সবাই বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। যুদ্ধ গাজার অর্ধের বেশি মানুষের জীবনকে দুমড়েমুচড়ে দিয়েছে। যদিও ইসরায়েলি বাহিনী বলছে, তারা বেসামরিকদের হতাহত হওয়া এড়িয়ে যাওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। বলছে, আকাশ হামলার আগে তারা বেসামরিক নাগরিকদের সরে যেতে সতর্কবার্তাও দিচ্ছে।
গাজা যুদ্ধে এখন পর্যন্ত প্রায় ২৫ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। যাদের মধ্যে সাড়ে ১১ হাজারের বয়স ১৮ বছরের নিচে ছিল। আরো বহু মানুষ আহত হয়েছে। যাদের অনেককে আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করতে হবে।
যদিও গাজা যুদ্ধের প্রকৃত চিত্র পাওয়া খুবই কঠিন। তবে ইউরো-মেডিটেরানিয়ান হিউম্যান রাইটস মনিটরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গাজা যুদ্ধে ২৪ হাজারের বেশি শিশু বাবা অথবা মা বা উভয়কেই হারিয়েছে।
আহত, ক্ষুধার্ত ও একা: গাজার যুদ্ধে এতিম হচ্ছে শিশুরা
পায়ে আর পেটে মারাত্মক ক্ষত নিয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছে ১০ বছরের ইব্রাহিম আবু মোউস। তবে তার চোখের পানি শরীরের যন্ত্রণার কারণে নয় বরং তাদের বাড়িতে হওয়া ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিহত তার মা, দাদি ও বোনের জন্য।
হুসেইন পরিবারের চাচাতো ভাইবোনেরা সবসময় একসঙ্গে খেলাধুলা করতো। কিন্তু এখন তারা একটি কবরস্থানের পাশে চুপচাপ বসে থাকে। ওই কবরস্থানে তাদের প্রত্যেকের মা অথবা বাবা অথবা দুইজনেরই কবর রয়েছে।
আহত, ক্ষুধার্ত ও একা: গাজার যুদ্ধে এতিম হচ্ছে শিশুরা
আবেদ হুসেইন বলে, “ক্ষেপণাস্ত্র এসে ঠিক আমার মায়ের কোলের উপর পড়ে এবং তার দেহ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কয়েকদিন ধরে বাড়ির ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে আমরা তার দেহাংশ খুঁজে খুঁজে বের করেছি।”
শিশুটি এখন একটি শরণার্থী শিবিরে থাকে। বলে, “যখন তারা বললো আমার ভাই, চাচা এবং আমার পুরো পরিবার নিহত হয়েছে। আমার মনে হলো আমার হৃদয়ের ভেতর আগুনের স্রোত বইছে।
“যখন আমার বাবা-মা বেঁচে ছিলেন তখন আমি ঘুমাতাম। কিন্তু এখন আমি আর ঘুমাতে পারি না। আমি আমার বাবার পাশে ঘুমাতাম।”
আবেদ ও তা বেঁচে যাওয়া দুই ভাইবোনকে এখন তাদের দাদি দেখাশুনা করে। কিন্তু প্রতিটা দিনই তাদের জন্য নরক যন্ত্রণার।
আবেদ জানায়, তাদের খাওয়ার মত কোনো খাবার বা পানি নেই। সমুদ্রের নোনা পানি খেয়ে তার পেট ব্যথা করে।
গাজায় এখন প্রতিটি প্রাণ ত্রাণের উপর নির্ভর করে বেঁচে আছে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, গাজায় প্রায় ১৭ লাখ মানুষ এখন গৃহহীন।
তবের জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের মূল উদ্বেগ গাজার প্রায় ১৯ হাজার শিশুকে নিয়ে। যারা এতিম। এমনকি তাদের দেখাশুনা কারার মত কোনো প্রাপ্ত বয়স্ক স্বজনও নেই।
ইউনিসেফ প্যালেস্টিনিয়ান এর জনসংযোগ বিষয়ক প্রধান জনাথন ক্রিক্স বলেন, “এই সব শিশুদের বেশিরভাগকেই তাদের বাড়ির ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। হামলায় তারা তাদের বাবা-মা কে হারিয়েছে।
“তাদের মধ্যে এত ছোট ছোট শিশুরাও রয়েছে যারা এমনকি নিজেদের নাম পর্যন্ত বলতে পারে না। বড়দের কেউ কেউ এতটাই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে আছে যে কোনো কথাই বলতে পারছে না। তাই তাদের নামপরিচয় বের করা এবং পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা খুব কঠিন হয়ে পড়েছে।”
স্বজনদের কাউকে কাউকে খুঁজে পাওয়া গেলেও তারা নিজেরাই এত দুর্দশার মধ্যে রয়েছেন যে শিশুদের দেখাশুনা করা তাদের পক্ষে সম্ভব না।
গাজার প্রায় প্রতিটি শিশুর এখন মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসার ও সহায়তার প্রয়োজন বলে মনে করে ইউনিসেফ। তাদের জীবন দুমড়েমুচড়ে গেছে। তাই এমনকি যদি একটি দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধবিরতিও হতো তা হলেও এইসব শিশুদের অনেককে তারা যে যন্ত্রণাময় জীবনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সেটা থেকে তাদের বের করে আনা যেত বলে মনে করে ইউনিসেফ।
সুত্রঃ বিডি নিউজ ২৪.কম