যুগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগোচ্ছে প্রযুক্তি। তবে সামাজিক পরিবর্তন সবসময়ই ইতিবাচকভাবে হয় না। প্রযুক্তির সঙ্গে সমাজের বিচ্ছিন্নতাও চোখে পড়ার মতো। প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সঙ্গে হয়রানি-নির্যাতনের ধরনও পাল্টেছে। ভুক্তভোগীর ক্ষেত্রে নারী আজও সবসময় শীর্ষে। কাউকে ফাঁসাতে বা ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে নারীকে নির্যাতন বা হয়রানির কথাই বলতে হয়।
এ সময়ে উন্নত প্রযুক্তির যুগে নারী নির্যাতন নতুন রূপ পেয়েছে। গোপনে ছবি তুলে, সম্পর্কের অবনতিতে অন্তরঙ্গ ছবি ছড়িয়ে, কৌশলে মোবাইল ফোন থেকে ব্যক্তিগত ছবি নিয়ে অথবা ছবি সম্পাদনা করে নারীকে হেয় করার পন্থা এখন অনেকটাই পুরোনো। এখন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ফটো শেয়ারিং ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো প্রযুক্তি।
রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সামিয়া (ছদ্মনাম)। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহপাঠী ছেলের সঙ্গে তাঁর ভালো বন্ধুত্ব হয়। সম্প্রতি ওই বন্ধুটি তাঁর কিছু ব্যক্তিগত ছবি দেখিয়ে টাকা দাবি করে। নিজের ও পরিবারের কথা ভেবে সামিয়া কিছুদিন টাকা দিলেও বারবার টাকা দাবি করায় তিনি বিষয়টি পুলিশকে জানান। ওই সহপাঠীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
রাজধানীর এক উঠতি মডেল ফারলিন (ছদ্মনাম)। সম্প্রতি তাঁর একটি অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও পোস্ট করা হয়। এ নিয়ে তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। এটি তাঁর ভিডিও নয় দাবি করলেও, তা অনেকেই আমলে না নিয়ে অনলাইন ট্রায়ালে তোলেন তাঁকে। তবে পরিবারের সহযোগিতা থাকায় তিনি পুলিশের আশ্রয় নেন। দেখা যায়, ওই ভিডিওটি ভুয়া বা ডিপ-ফেইক। সেখানে ব্যবহার করা হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এভাবে নিত্যনতুন
প্রযুক্তির অপপ্রয়োগ হচ্ছে। প্রযুক্তিকে ব্যবহার করা হচ্ছে নারী নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে।
সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের গবেষণা জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ২০২২ সালে সংঘটিত নতুন ধরনের অপরাধের মাত্রায় নিত্যনতুন ও অভিনব কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে সাইবার দুর্বৃত্তরা। এসব অপরাধের মধ্যে রয়েছে নানা মাত্রিক প্রতারণা। যেমন চাকরি দেওয়ার মিথ্যা আশ্বাস, ভুয়া অ্যাপে ঋণ দেওয়ার ফাঁদ, সেবা বা পণ্য বিক্রির নামে প্রতারণা ইত্যাদি। সাইবার অপরাধে শিশু ভুক্তভোগীর হার বেড়েছে ১৪০ দশমিক ৮৭। ভুক্তভোগী ৭৫ শতাংশই তরুণ, যাদের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। লিঙ্গভিত্তিক তুলনামূলক পরিসংখ্যানে সাইবার অপরাধের ভুক্তভোগীর মধ্যে নারীর হার বেশি, ৫৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ। প্রযুক্তি অনেক এগিয়েছে। এসব ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা কঠিন। যথাযথ আইন ও তার প্রয়োগ যেমন দরকার; তেমনি দরকার সামাজিক সচেতনতা– এমনটিই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের পরিচালক (প্রোগ্রাম) বনশ্রী মিত্র নিয়োগী বলেন, ‘প্রযুক্তি ভালো-মন্দ হয় না। তাকে ইতিবাচকভাবে ব্যবহার না করে নারীর ক্ষেত্রে নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করাটা আসলে মানসিকতার বিষয়। যিনি নারীকে সম্মান করেন না, মর্যাদা দেন না; তিনি নারীকে হেয় করতে যে কোনো কিছু ব্যবহার করতে পারেন। প্রযুক্তির ব্যবহার ও তার প্রয়োগের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের যেমন সচেতন হওয়া উচিত, তেমনি সমাজের সর্বস্তর থেকেই সচেতনতা জরুরি।’ তিনি আরও বলেন, ‘নারী নির্যাতকমাতে হলে ছেলেদের বেশি বেশি করে নারীবিষয়ক কাজে যুক্ত করতে হবে। এর মধ্য দিয়ে তাদের মানসিকতার পরিবর্তন হবে। সমাজের পরিবর্তনে এটিই বেশি দরকার।’
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারপারসন জেড আই খান পান্না বলেন, ‘সাইবার নিরাপত্তা আইনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে এর সংশোধন দরকার; যাতে এর অপপ্রয়োগ না হয়। প্রযুক্তি ব্যবহার করে যেমন নারী নির্যাতন করা হচ্ছে, তেমনি এ প্রযুক্তি নেতিবাচকভাবে যে কারও বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হতে পারে। এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে যে ভুয়া ছবি-ভিডিও তৈরি হচ্ছে, সেখানে আসল-নকলের পার্থক্য করাটাই দায়! এসব ক্ষেত্রে সাইবার নিরাপত্তা আইনের বিধান জরুরি।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রযুক্তি থেকে দূরে তো থাকা যাবে না। প্রযুক্তি ব্যবহার করতেই হবে। এ ক্ষেত্রে যথাযথ আইন ও তার প্রয়োগ খুব দরকার। তবে আমাদের দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সাইবার নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ হয়। দ্রুত ও সঠিক তদন্ত এ ক্ষেত্রে অপরিহার্য। তা সম্ভব হলে সাইবার ট্রাইব্যুনালে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।’
প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে গেলে সঙ্গীর ছবি বা ভিডিও অনলাইনে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা এখন প্রতিনিয়তই হচ্ছে। নারীকে হেয় করার মানসিকতাকে নিজেদের পুরুষত্ব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে দেখেন অনেক পুরুষ। নারীরা আগের চেয়ে অনেক বেশি বাইরে আসছেন, সমাজে নানা ক্ষেত্রে তাদের বিচরণ বেড়েছে। পাবলিক প্লেসে তাদের এখন অনেক বেশি চলতে হয়। এটিকে ভালোভাবে নিচ্ছেন না অনেক পুরুষ। তারা সুযোগ পেলেই হেনস্তা করেন। নারীদের হেনস্তা করা বা তাদের ছবি-ভিডিও ছড়িয়ে অনেকে নিজের পরিচিতজনদের মধ্যে বাহবা পেতে চান।
আর নারীর শরীরবিষয়ক কিছু অনলাইনে এলেই প্রথমে যে জিনিসটা হয়, তা হলো নারীকে সবকিছুর জন্য দোষারোপ করা। নারীর ওই ছবিটি আসল না নকল, তা দেখার কোনো দরকার নেই। ঢালাওভাবে অনলাইন ট্রায়াল চলতে থাকে। জনপরিসরে কোনো পুরুষ কিছু একটা করলে সেই ভিডিও ভাইরাল হয় না; নারী কিছু একটা করলেই তা ভাইরাল। এটিও পুরুষতান্ত্রিকতারই চিত্র। মানবাধিকার ব্যক্তিত্ব শিরীন হক বলেন, ‘অবশ্যই সবকিছু নারীর ওপর আসা উচিত নয়। নারীর প্রতি যে সহিংসতা বা নির্যাতন হচ্ছে বিভিন্ন মাধ্যমে, সেটি পুরুষতান্ত্রিক। সমাজের পুরুষতান্ত্রিকতারই প্রকাশ। কিন্তু বড় প্রশ্ন হলো, আমরা কীভাবে প্রতিরোধ করব।’ তিনি আরও বলেন, ‘এ নতুন বিষয়টি নিয়ে সবার, বিশেষত নারীদের প্রশিক্ষণ জরুরি, কীভাবে আমরা নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারি। কারণ শুধু আইন দিয়ে তা সম্ভব নয়। প্রযুক্তির জ্ঞান থাকতে হবে।’
নারী অধিকারবিষয়ক প্রতিষ্ঠান নারীপক্ষের সভানেত্রী তাসনীম আজীম বলেন, ‘আমাদের অবশ্যই অনলাইনে সতর্ক থাকতে হবে। প্রযুক্তি জ্ঞান বাড়াতে হবে। এর সঙ্গে থাকতে হবে সামাজিক শিক্ষা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ও নারীর অবস্থানকে সামনে রেখে যদি আমরা এমন প্রশিক্ষণ আয়োজন করতে পারি তাহলে ভিন্ন একটা আঙ্গিক দাঁড়াতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এ বিষয়গুলো আরও বেশি বেশি সামনে আসা দরকার। এ ক্ষেত্রে মিডিয়ার বড় ভূমি
সুত্রঃ সমকাল