বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার গুলশানে হোলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় ভয়াবহ জঙ্গি হামলার আট বছর পর এসে এখন দেশের কথিত ইসলামপন্থী জঙ্গি সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব, নেটওয়ার্ক এবং পুনর্গঠিত হবার শক্তি অনেকটাই বিপর্যস্ত হয়ে গেছে বলে বলছেন পুলিশ ও গবেষকরা। তবে জঙ্গি তৎপরতা পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি।
পুলিশের ধারাবাহিক অভিযানে বেশ কিছু জঙ্গি নেতার মৃত্যু, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জঙ্গিকে আটক, বৈশ্বিক জঙ্গি তৎপরতা কমে আসা এবং বিচারে অনেকের শাস্তি হওয়ায় জঙ্গি সংগঠনগুলো আর পুনর্গঠিত হবার সুযোগ পায়নি বলে কর্মকর্তাদের দাবি।
যদিও এর মাঝেই ঢাকার আদালত থেকে পরিকল্পিতভাবে দুই জঙ্গির পালিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে, যাদের এখনো গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। ঢাকার বাইরে কয়েকটি স্থানে জঙ্গি বিরোধী অভিযান চালানোর ঘটনাও ঘটেছে।
আনসার আল ইসলাম নামে একটি সংগঠনের তৎপরতা এখনো মাঝে মধ্যে দেখা যাচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জঙ্গি হামলা হচ্ছে না বলে জঙ্গি তৎপরতা নেই-এমনটি ভাবার সুযোগ নেই।
বাংলাদেশে ১৯৯৯ সালের ৬ই মার্চ যশোরের টাউন হল ময়দানে উদীচী শিল্প গোষ্ঠীর সম্মেলনে বোমা হামলার ঘটনা জঙ্গিদের বড় উত্থান হিসেবে বিবেচনা করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। এরপর ২০০১ সালে ঢাকায় রমনার বটমূলে ও সিপিবির সমাবেশে বোমা হামলার ঘটনাগুলোতেও জঙ্গিদের সংশ্লিষ্টতার খবর উঠে এসেছিলো।
এরপর সিনেমা হল, গির্জায় অনেকগুলো হামলার ঘটনা ঘটে। ২০০৫ সালের অগাস্টে সিরিজ বোমা হামলায় আবারো জঙ্গি তৎপরতার বিষয়টি আলোচনায় আসে। এক পর্যায়ে উঠে আসে জঙ্গি সংগঠন জেএমবি বা জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের নাম।
এক পর্যায় তাদের আটক করা হয় এবং জেএমবি নেতা শায়খ আব্দুর রহমান এবং বাংলাভাই নামে পরিচিত সিদ্দিকুল ইসলামসহ সাত জনের ফাঁসি হয় ২০০৭ সালে। এরপরেও বিভিন্ন সময়ে বিদেশী নাগরিক হত্যাসহ নানা ঘটনায় জঙ্গিদের নাম আসে।
তবে ২০১৬ সালে ঢাকার গুলশানে হোলি আর্টিজান হামলায় বহু বিদেশি নাগরিক নিহত হওয়ায় সেই ঘটনাটি বিশ্ব জুড়ে খবরের শিরোনাম হয়। ওই ঘটনার জন্য পুলিশ দায়ী করে নতুন ভাবে গড়ে ওঠা জেএমবি অর্থাৎ নিউ জেএমবি হিসেবে পরিচিত সংগঠনকে।
ইসলামপন্থী জঙ্গি সংগঠনগুলোর এখন কী অবস্থা
পুলিশ বলছে একের এর এক অভিযানে নেতৃত্ব শূন্য ও নেটওয়ার্ক বিধ্বস্ত হয়ে গেছে জঙ্গি সংগঠনগুলো। বিশেষ করে হোলি আর্টিজানের ঘটনার পরের তিন বছরেই সারাদেশে অভিযানে অন্তত ৮০ জন জঙ্গি নিহত হয় এবং তিনশোর বেশি গ্রেফতার হয়েছিলো।
“এরা হয়তো একবারেই নির্মূল হয়নি, তবে সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। নেতৃত্ব বলতে কিছু নেই। যা কিছু তৎপরতা আছে সেটা অনলাইন ভিত্তিক। আমাদের সেদিকেও নজর আছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বা সিটিটিসির প্রধান মো. আসাদুজ্জামান।
তবে বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের অধীনে টেরোরিজম রিসার্চ ইন্সটিটিউটের প্রধান শাফকাত মুনীর বলছেন সহিংস উগ্রবাদের চ্যালেঞ্জ অনেকটাই প্রশমিত হয়েছে কিন্তু জঙ্গি হামলা হচ্ছে না বলে জঙ্গি তৎপরতা নেই-এমনটি ভাবার সুযোগ নেই।
“হোলি আর্টিজানের ঘটনার পর ধারাবাহিক অভিযানে তারা অনেকটাই কাবু হয়েছে সত্যি কিন্তু বড় যে চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে সেটি হলো আদর্শিক চ্যালেঞ্জ। এটা ভাবার সুযোগ নেই যে সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। দু একটি সংগঠন এখনো মাঝে মধ্যে তৎপরতা দেখাচ্ছে,” তিনি বলেন।
“তাদের অস্তিত্ব নেই এমনটি ভাবলে হবে না। অনলাইন জগতে সেটা দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ হুমকিটা আছে,” বলছিলেন তিনি।
সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামানও বলছেন যে সাইবার স্পেসে জঙ্গিদের তৎপরতা আছে এবং সেদিকে দৃষ্টি রেখেই তারা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।
তবে ধারাবাহিক অভিযানে এবং কয়েক স্তরের শীর্ষ নেতাদের বিভিন্ন অভিযানে মৃত্যু ও গ্রেফতারের পরেও বিভিন্ন সময়ে নানা নামে কিছু সংগঠন গড়ে উঠেছে এবং বিচ্ছিন্নভাবে কিছু হামলার ঘটনাও ঘটেছে।
এর মধ্যে দুটি সংগঠন কয়েক দফায় আলোচনায় এসেছে- আনসার আল ইসলাম ও জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া। এমনকি জেএমবির যারা কারাগারে ছিলেন তাদের সাথে কারাগারেই এ দুটি সংগঠনের দেখা বা বৈঠক হয়েছে এমন খবরও এসেছে বিভিন্ন সময়ে। এ দুটি সংগঠনই আল-কায়েদার মতাদর্শে গড়ে ওঠা বলে বিশ্লেষকরা অনেকে মনে করেন।
যদিও সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামিক স্টেট বা আইএসের তৎপরতা কমে আসার প্রভাব পড়েছে এ অঞ্চলের জঙ্গি সংগঠনগুলোর মধ্যেও।
হোলি আর্টিজান হামলায় জড়িত সাত জঙ্গির সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছিলো হাইকোর্ট
আবার আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার নামের সাথে উঠে এসেছে পাহাড়ে কুকি-চিনের মতো ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সংগঠনের নাম,যা অনেককেই বিস্মিত করেছে।
মো. আসাদুজ্জামান বলছেন আনসার আল ইসলাম কিছুটা সক্রিয় আছে বলে তারা মনে করেন।
“এরা ক্লাস্টার ভিত্তিতে কাজ করে। এদের আইটি শাখা, বায়তুল মাল শাখা, রাওয়া শাখার মতো নামে নানা উইং আছে। সম্প্রতি নেত্রকোনায় তাদের একটি আস্তানায় আমরা অভিযান চালিয়েছি,” তিনি বলেন।
তিনি জানান অন্য আরও দু একটি গোষ্ঠী অনলাইনে সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
“তারা রিক্রুটমেন্ট, প্রচারণা. ট্রেনিং মডিউল শেয়ার করছে। অনলাইনে নজরদারি করে তাদের শনাক্ত করা হচ্ছে”।
“যদিও তারা যাই করুক কিংবা যত ভাবেই চেষ্টা করুক আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। আমাদের ধারাবাহিক কার্যক্রমের কারণেই ২০২১ সালের পর বাংলাদেশে আরও কোন জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেনি। জঙ্গিদের সেই সক্ষমতাও আর নেই বলেই আমরা মনে করি,” বলছিলেন মি. আসাদুজ্জামান।
এর পাশাপাশি বিভিন্ন সময় আটক হয়ে জেলে আছে এমন ৫৪ জন জঙ্গিকে ডি-রেডিক্যালাইজেশন কর্মসূচির আওতায় নানা ধরনের কাউন্সেলিং করানো হচ্ছে, যাতে তারা জামিনে বের হয়ে এসে অতীতের আদর্শে যেন ফিরে না যায় এবং যারা সাজা খেটে বের হচ্ছে তারা যেন পুরনো দলে আর না ফিরে।
যদিও ২০২২ সালের ২০শে নভেম্বর ঢাকার কারাগার চত্বরে পুলিশের ওপর হামলা করে দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয়ার পর দেড় বছর পার হলেও এখনো তাদের আটক করতে পারেনি পুলিশ।
“দু’জন পলাতক- এটা আমাদের টপ প্রায়োরিটি। তারা সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি। তাদের শনাক্ত ও গ্রেফতার করা আমাদের প্রায়োরিটি। আমরা আশাবাদী তারা ধরা পড়বে। তারা দেশেই আছে। গ্রেফতার হবে,” বলছিলেন মো. আসাদুজ্জামান।
টেররিজম রিসার্চ ইন্সটিটিউটের প্রধান শাফকাত মুনীর বলছেন পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হলেও আদর্শিক হুমকি মোকাবেলার চ্যালেঞ্জ আছে।
“এ সমস্যা অনলাইন জগতে বেশি। রেডিকেলাইজেশনের চ্যালেঞ্জ। তাদের ভ্রান্ত আদর্শ যেন তরুণদের মধ্যে ছড়ানোর চেষ্টা ব্যাহত করতে হবে। বিশ্বের অন্য জায়গায় জঙ্গিবাদের হুমকি মাথাচাড়া দিয়ে উঠলেও বাংলাদেশে যেন তা দেখা না যায় তা নিয়ে সচেষ্ট থাকতে হবে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
হোলি আর্টিজানে যেভাবে হামলা হয়েছিলো
দুই হাজার ষোলো সালের পহেলা জুলাই গুলশানের অভিজাত রেস্তোরাঁ হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গিরা হামলা করে এবং সেখানে থাকা অতিথিদের জিম্মি করে। সেদিন রাত সোয়া নয়টার দিকে সেখানে প্রচণ্ড গোলাগুলি হয়।
এক পর্যায়ে পুলিশ এগিয়ে গেলে বনানী থানার ওসি সালাউদ্দীন গুলিবিদ্ধ হন ও পরে হাসপাতালে মারা যান। রাত দশটার দিকে পুলিশ ছাড়াও র্যাব এবং আধা সামরিক বাহিনী বর্ডার গার্ডস বাংলাদেশের কয়েকশো সদস্য ঘটনাস্থলে গিয়ে অবস্থান নেয়।
হামলার রাতেই ইসলামিক স্টেট জঙ্গি গোষ্ঠী তাদের বার্তা সংস্থা বলে পরিচিত ‘আমাক’এ গুলশান এর এই হামলার দায় স্বীকার করে ২০ জন নিহত হবার কথা জানায়। আইএসের পক্ষ থেকে হামলাকারীদের মধ্যে পাঁচজনকে তাদের ‘সৈনিক’ বলে দাবি করে এবং ওই হামলার দায়িত্বও স্বীকার করে নেয় জঙ্গি গোষ্ঠীটি।
রাতভর রেস্টুরেন্ট সংলগ্ন এলাকা ঘিরে রাখার পর সকাল সাড়ে সাতটার কিছুক্ষণ পর সেনা, নৌ, পুলিশ, র্যাব এবং বিজিবির সমন্বয়ে গঠিত দল কমান্ডো বাহিনী অভিযান শুরু করে ও রেস্টুরেন্টের ভেতরে প্রবেশ করে। এসময় প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়।
সোয়া নয়টা পর্যন্ত চলমান এ কমান্ডো অভিযানের মধ্য দিয়ে প্রায় বার ঘণ্টার রক্তাক্ত জিম্মি সংকটের অবসান হয় এবং তখন বিদেশীসহ তের জনের জীবিত উদ্ধারের খবর জানানো হয়। রেস্টুরেন্টের ভেতরে অজ্ঞাত পাঁচজনের মৃতদেহ পাবার কথা পুলিশ জানায়।
বেলা বারটার কিছুক্ষণ আগে জঙ্গিদের ছয় জন নিহত এবং একজন ধরা পড়েছে বলে নিশ্চিত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে দুপুর দেড়টায় আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর বা আইএসপিআর থেকে রেস্টুরেন্ট থেকে ২০টি মৃতদেহ উদ্ধারের কথা জানায়।
বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তৈরি করা ওই ঘটনায় জঙ্গিরা ওই রাতে যে ২০ জনকে হত্যা করে তাদের মধ্যে ৯ জন ইতালি, ৭ জন জাপান, ৩ জন বাংলাদেশি এবং ১ জন ভারতীয় নাগরিক ছিলেন।
এছাড়া সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডো অভিযানে হামলাকারী পাঁচজনও প্রাণ হারায়। এরা হলো- রোহান ইমতিয়াজ, খায়রুল ইসলাম পায়েল, সামিউল মোবাশ্বির, শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল এবং নিবরাস ইসলাম।
শাফকাত মুনীর
হামলায় কারা ছিলো এবং পরে তাদের কী হয়েছে
হামলার রাতেই ইসলামিক স্টেট জঙ্গি গোষ্ঠী তাদের বার্তা সংস্থা বলে পরিচিত ‘আমাক’ এ গুলশান এর এই হামলার দায় স্বীকার করে এবং হামলাকারীদের ছবি প্রকাশ করলেও বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কখনো তা স্বীকার করেনি।
বরং পুলিশের কাউন্টার টেররজিম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বা সিটিটিসি সবসময়ই বলে আসছে যে ঘটনাটি নিউ জেএমবি নামের জঙ্গি সংগঠন ঘটিয়েছে।
“ হোলি আর্টিজানের হামলায় যে সংগঠনটি অংশ নিয়েছিলো তা হলো নব্য জেএমবি। বাংলাদেশে সক্রিয় জঙ্গি সংগঠনের বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনা করলে এরাই ছিলো সবচেয়ে ভয়ংকর। অনেক হামলা করেছিলো। পরে সিটিটিসি অভিযান করে সংগঠনের নেটওয়ার্ক বিধ্বস্ত করে দেয়,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান।
জঙ্গি সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে একাধিক অভিযান চালিয়েছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন বা র্যাবও।
হোলি আর্টিজানে কমান্ডো অভিযানে সরাসরি অংশ নেয়া জঙ্গিরা নিহত হবার পর পুলিশ জঙ্গি বিরোধী ব্যাপক অভিযান শুরু করে এবং আরও আটজনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।
এর এক বছর পর ২০১৭ সালে মামলার অভিযোগপত্র দেয়া হয় এবং বিচারে আদালতে সবাইকে ফাঁসি দেয় এবং একজনকে খালাস দেয়। পরে উচ্চ আদালতে আসামীদের ফাঁসির পরিবর্তে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়।
তবে এরপরেও তারা একেবারে থেমে যায়নি বলে বলছেন মো. আসাদুজ্জামান।
“সবশেষ আমাদের তথ্যের ভিত্তিতে মাহাদী হাসানকে তুরস্কের পুলিশ আটক করেছে। মাহাদী হাসানের পর যে চেষ্টা করেছে তাকেও গ্রেফতার করেছে। তবে যে দু একজনকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি তারা কখনো সংগঠিত হবার চেষ্টা করেছে,” বলছিলেন তিনি।
সুত্রঃ বিবিসি বাংলা