৩১ জুলাই দুপুর ১২টা। ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে অন্য সব শিক্ষার্থীর মতো নুসরাতও হাজির হয়েছিলেন স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রাঙ্গণে। কর্মসূচি শুরু হওয়ার অপেক্ষায় সবাই। সেদিনের কর্মসূচি ছিল মার্চ ফর জাস্টিস। গন্তব্য হাইকোর্ট। সময় গড়াতে থাকে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে নুর হাসান, ইফাজ, বিধান, ওমাইদাসহ আরও অনেকের সঙ্গে নুসরাতও রওনা দেন হাইকোর্টের দিকে। পথে তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হন ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থী। একসঙ্গে গেলে পুলিশ তাঁদের আগেই ছত্রভঙ্গ করে দেবে। তাই আলাদা হয়ে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে দুজন দুজন করে তাঁরা পৌঁছে যান হাইকোর্টের সামনে।
মনের ভয় দূরে ঠেলে প্রতিবাদের শক্তিকে পুঁজি করে একটা সময় তাঁরা পৌঁছে যান হাইকোর্ট মাজার গেটে। তখন সেখানে আইনজীবীরা প্রতিবাদ করছিলেন। সেখান থেকে কিছুটা দূরে অবস্থান নেয় সাতজনের এই দল। সেখানে আগে থেকেই বিভিন্ন স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা শিক্ষার্থীরা ছিলেন। ধীরে ধীরে সেই সংখ্যা শয়ের ঘর ছাড়িয়ে যায়। অবস্থান নেওয়ার প্রায় ১০ মিনিট পর দুজন টহল পুলিশ সাতজনের দলটিকে দেখে ফেলে। এই সাতজনও বুঝতে পারেন, তাঁরা টার্গেটে পরিণত হয়েছেন। সরে যাওয়ার আগেই পুলিশ এসে তাঁদের চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলতে শুরু করে। ফলে সবাই বিভিন্ন দিকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। পুলিশ সেখানে উপস্থিত ছেলেদের আটক করতে থাকে। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকার কারণে নুরকে নিয়ে যাওয়ার সময় নুসরাত তাঁর হাত ধরে রাখেন, পুলিশকে বাধা দেন। একসময় একজন পুলিশ সদস্য নুসরাতের হাতে আঘাত করেন। ফলে তাঁর হাত ছুটে যায় এবং নুরকে নিয়ে যায় পুলিশ। কিন্তু হাল ছাড়েননি নুসরাত। ছুটে এসে আবার নুরকে ধরেন তিনি। পুলিশ আর নুসরাতের টানাহেঁচড়ার একপর্যায়ে আবারও নুরের হাত ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে নুসরাতের পক্ষে। এবার তিনি নুরের বেল্ট ধরে ফেলেন।
শিক্ষার্থীদের আটক করার সংবাদ রটে গেলে সেখানে জড়ো হন সাংবাদিকেরা। তাঁরা ছবি তুলতে থাকেন। একপর্যায়ে পুলিশ এক সাংবাদিককে লাথি মারে। এতে সাংবাদিকেরা পুলিশকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন। সে সময় কেউ একজন সেখান থেকে নুসরাতকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। এর পরেও পুলিশ নুরসহ অন্য ছেলেদের ভ্যানে তোলে। এর প্রতিবাদে নুসরাত একা দাঁড়িয়ে যান পুলিশের গাড়ির সামনে। দুই হাত দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করেন গাড়িটি। কাঁধে ব্যাগ আর চোখে চশমা পরে পুলিশের গাড়ির সামনে প্রতিরোধের আইকন হয়ে ওঠা নুসরাতের ছবি ছড়িয়ে যায় সংবাদমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
কাঁধে ব্যাগ আর চোখে চশমা পরে পুলিশের গাড়ির সামনে প্রতিরোধের আইকন হয়ে ওঠা নুসরাতের ছবিকাঁধে ব্যাগ আর চোখে চশমা পরে পুলিশের গাড়ির সামনে প্রতিরোধের আইকন হয়ে ওঠা নুসরাতের ছবি
তাঁর পুরো নাম নুসরাত জাহান টুম্পা। ছাত্র-জনতার মিলিত আন্দোলনের প্রথম অভিঘাত থেমে গেলে, ১২ আগস্ট নুসরাতের সংঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি শোনান সেদিনের ঘটনার অনুপুঙ্খ বিবরণ।
নুসরাত জানান, পুলিশ অন্যায়ভাবে কাউকে আটক করতে পারে না বলেই বাধা দিচ্ছিলেন তিনি। তিনি জানতেন না, তাঁর সেই প্রতিবাদী ভঙ্গি হাজারো মানুষকে প্রতিবাদী করে তুলবে। তিনি তখন শুধুই ভাবছিলেন, আন্দোলনকারীদের অন্যায়ভাবে আটক করা চলবে না। পুলিশ শিক্ষার্থীদের, বিশেষ করে ছাত্রদের আটক করছে। কিন্তু কেউ তাঁদের রক্ষা করছে না। এ বিষয়টি তাঁর মনে জন্ম নিয়েছিল ক্ষোভ। সেটা প্রশমিত করতেই তিনি দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন পুলিশের গাড়ির সামনে। তাঁর এ প্রতিরোধ দেখে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে আইনজীবীরা মার্চ ফর জাস্টিসের স্লোগান দিতে শুরু করেন। বিষয়টি মুহূর্তে মন ভালো করে দিয়েছিল নুসরাতের। এর দুই ঘণ্টা পর স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির শিক্ষকদের জানানো হলে সেখান থেকে আইন বিভাগের দুজন শিক্ষক এবং দুজন আইনজীবী রমনা মডেল থানা থেকে আটক চার শিক্ষার্থীকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান। ইতিমধ্যে পুলিশের গাড়ির সামনে দাঁড়ানো নুসরাতকে নিয়ে আঁকা হয়েছে কার্টুন ও গ্রাফিতি।
জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সব বয়সের নারীরা ন্যায়ের জন্য, ন্যায্যতার জন্য কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রতিবাদ করেছেন। tছবি: সংগৃহীতজুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সব বয়সের নারীরা ন্যায়ের জন্য, ন্যায্যতার জন্য কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রতিবাদ করেছেন। ছবি: সংগৃহীত
আর দশটা পরিবারের মতো নুসরাতের নিরাপত্তা নিয়ে ভয় থাকলেও পরিবার তাঁর পাশে ছিল আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে। স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের ৮১ ব্যাচের এই শিক্ষার্থী স্বপ্ন দেখেন, বাংলাদেশ হবে সাধারণ মানুষের দেশ।
জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সব বয়সের নারীরা ন্যায়ের জন্য, ন্যায্যতার জন্য কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রতিবাদ করেছেন। নারীদের এই সাহসী অংশগ্রহণ লক্ষ্য অর্জনকে ত্বরান্বিত করেছে। সেই ইতিহাসের এক প্রতিবাদী চরিত্র হিসেবে আমাদের মনে থাকবেন নুসরাত জাহান টুম্পা।
সুত্রঃ আজকের কাগজ