আজ ২৪ আগস্ট। ইয়াসমিন হত্যা দিবস ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস। ২৯ বছর আগে ১৯৯৫ সালের এই দিনে দিনাজপুরের কিশোরী ইয়াসমিনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। এতে জড়িত ছিল কয়েকজন পুলিশ সদস্য। ঘটনার প্রতিবাদে আন্দোলনরত বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ। নিহত হন ৭ ব্যক্তি। দিনাজপুরে এই দিনটিকে ইয়াসমিন হত্যা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। আর সারা দেশে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
মাকে দেখার জন্য ঢাকা থেকে দিনাজপুরে বাড়ি ফিরছিল কিশোরী ইয়াসমিন। দিনাজপুরের বাসে উঠতে না পেরে পঞ্চগড়গামী একটি বাসে উঠে পড়ে। দিনাজপুরের দশ মাইলে নামিয়ে দেওয়া হয় তাকে। স্থানীয় একটি চায়ের দোকানে বসে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিল। এলাকাবাসী ইয়াসমিনের নিরাপত্তার কথা ভেবে খুব ভোরে পুলিশের গাড়িতে তুলে দেয়; কিন্তু মায়ের কাছে ইয়াসমিন ফেরে লাশ হয়ে। পথে ইয়াসমিনকে পুলিশ সদস্যরা সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে। এরপর ইয়াসমিনকে হত্যা করে লাশ সদর উপজেলার ব্র্যাক অফিসের পাশে রাস্তায় ফেলে যায়। পরদিন ঘটনা জানাজানি হলে কয়েক হাজার বিক্ষুব্ধ জনতা দিনাজপুর শহরে প্রতিবাদ মিছিল করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।
তৎকালীন পুলিশ প্রশাসন ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে উল্টো ইয়াসমিনকে যৌনকর্মী আখ্যা দেয়। সারা দেশের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। দেশের নারী সংগঠনগুলো সম্মিলিতভাবে ইয়াসমিন হত্যার ঘটনায় তুমুল প্রতিবাদ গড়ে তোলে। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রতি বছর দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত নেয় সংগঠনগুলো। তীব্র আন্দোলনের মুখে ওই পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। ১৯৯৭ সালের ৩১ আগস্ট মামলার রায়ও হয়। ইয়াসমিন ট্র্যাজেডির আট বছর পর ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বরে রায় অনুসারে দোষীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়।
সেসময় আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। তিনি কালবেলাকে বলেন, ১৪ বছরের ইয়াসমিন পুলিশ সদস্যদের দিয়ে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা সরকার অস্বীকার করেছিল। নারী নির্যাতন ঘরে-বাইরে নানাভাবে হয়; কিন্তু রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের বিরুদ্ধে আমরা আওয়াজ তুলেছিলাম। ২০১৬ সালের ২০ মার্চ কুমিল্লায় খুন হয়েছিলেন কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনু। তনু হত্যা সেনাবাহিনী দ্বারা হয়েছে। নারী সংগঠনগুলোর প্রতিবাদের কারণে অপরাধ সম্পর্কে মানুষের ধারণা সামান্য হলেও হয়েছে; কিন্তু আসল অপরাধীরা বিচারের আওতার বাইরেই থেকে গেছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা যতই বলি, আমাদের অগ্রগতি হয়েছে, আসলে নয়। কারণ নারী নির্যাতন কমেনি। নারী নির্যাতন প্রতিরোধ করতে হলে সব ধরনের ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় নারী নির্যাতন বন্ধে কাজ করতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম কাজ হবে ধর্ষণ, নির্যাতন ও হত্যার বিচারগুলো সম্পন্ন করা।
সেই আন্দোলনে অংশ নেওয়া বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ইয়াসমিন হত্যার বিচারের দাবিতে নারী সমাজ সোচ্চার ছিলাম। এরপরও নারীর প্রতি বৈষম্য ও নির্যাতনের মতো ঘটনা ঘটছে। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করতে যে আইনগুলো নারীকে পশ্চাৎপদ করে সেগুলো সংশোধন করতে হবে।
বাবা মোহাম্মদ ডাবলুর রহমান বলেন, ইয়াসমিন হত্যার বিচার চাইতে গিয়ে যারা মারা গেছেন, তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে এখনো যোগাযোগ রেখেছি। মেয়েরা লেখাপড়া শিখে আত্মনির্ভরশীল হলে তাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়বে।
ধর্ষণ নারীকে অবদমিত, অধস্তন অবস্থানে রাখার জন্য, নারীর মানবিক সত্তা, ব্যক্তিত্ব, মনুষ্যত্ববোধকে বিনষ্ট করার জন্য একটি শক্তিশালী অস্ত্র। বর্তমানে বাংলাদেশে দ্রুত পরিবর্তনশীল সমাজ বাস্তবতা, যা ব্যক্তিগত জীবন, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অগ্রসর হচ্ছে, নারীর পথচলা কিছুটা মসৃণ হচ্ছে। তার পাশাপাশি উদ্বেগজনক হারে অসংখ্য ধর্ষণের ঘটনা, নৃশংস রূপ ধারণ করছে, যে পাশবিক নিষ্ঠুরতা সমাজজীবনের এক বিশাল অংশকে সামগ্রিক অবক্ষয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সে অবস্থায় সংবিধানে ঘোষিত নারীর সম-অধিকার, মানবাধিকারের নীতিমালা, বৈশ্বিক মানবাধিকার সনদের নীতিমালা মারাত্মকভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে।
সুত্রঃ কালবেলা