ঢাকার গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার। জেলের প্রধান গেটে দিয়ে বের হলো আনসারুল্লা বাংলা টিম বা আনসারুল্লা আল ইসলাম-এর প্রধান, জসিমুদ্দিন রহমানি। বের হওয়ার সাথে সাথে তাঁর মাথায় পুষ্পবৃষ্টি করা হল। তারপর তিনি উঠল এক হুডখোলা কালো রঙের এসইউভিতে। তাকে দেখেই তীব্র চিৎকারে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করল উপচে পড়া জনতার ভিড়। হুডখোলা গাড়ি থেকে ডিক্টাফোনে বক্তৃতা শুরু করল ওই ব্যক্তি। গলার শিড় ফুলিয়ে বলল, “প্রতিশোধ চাই”। সমবেত জনতাও একসঙ্গে গর্জে উঠল ‘প্রতিশোধ, প্রতিশোধ…’। তিনি বলেন “শেখ হাসিনা দেখুন, আপনি যাকে জেলে রেখেছিলেন, সে আজ বাইরে। আর আপনি? দেশের বাইরে।” জনতার ভিড় থেকে উঠল আরও এক রাউন্ড চিৎকার। এরপর ঢাকার রাজপথে শোভাযাত্রা করে এগোল তার গাড়ি। তাকে নিরাপত্তা দিয়ে নিয়ে গেল সেই দেশের সেনা। কে এই ‘বিশিষ্ট’ ব্যক্তি? বাংলাদেশি জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লা বাংলা টিম বা আনসারুল্লা আল ইসলাম-এর প্রধান, জসিমুদ্দিন রহমানি।
শেখ হাসিনা তাকে জেল বন্দি করে রেখেছিলেন। গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে চলে এসেছেন শেখ হাসিনা। এখন সেই দেশে চলছে শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মহম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। আর তাঁর সরকারের আমলেই, সম্প্রতি জেল থেকে ছাড় পেয়েছে জঙ্গি নেতা মুফতি জসিমউদ্দিন রহমানি। বাংলাদেশে একাধিক নাস্তিক-যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক লেখকদের হত্যার সঙ্গে জড়িত তার সংগঠন আনসুরল্লাহ বাংলা টিম। এই জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের অনুপ্রেরণা, বিন লাদেনের আল কায়েদা। শুধু অনুপ্রেরণাই নয়, তারা ‘আল কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট’ বা ‘আইকিউইএস’-এর সঙ্গে যুক্তও বটে। যাদের লক্ষ্য, ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তানে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে ইসলামি রাষ্ট্র গঠন করা। তবে, আনসারুল্লাহ শুধু শেখ হাসিনার বাংলাদেশের মাথাব্যথা ছিল না। ভারতের জন্যও যথেষ্ট চিন্তার কারণ আনসার। আর বর্তমান বাংলাদেশে তাদের নেতাকে যেভাবে প্রায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পাহারা দিল তাদের সেনা, নয়া দিল্লির চিন্তার কারণ আছে বইকি!
আনসারুল্লা বাংলা টিমের উৎস
২০০০-এর প্রথম দশকে বাংলাদেশে ‘জামাতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ’ নামে এক ভয়ঙ্কর জঙ্গি গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়েছিল। আনসারুল্লা বাংলা টিমের উদ্ভব সেই জঙ্গি গোষ্ঠী থেকেই। ২০০৪ সালের ৩০ জুন, বাংলাদেশের বরগুনা সদর উপজেলায় এক জঙ্গি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে অভিযান চালিয়েছিল বাংলাদেশ পুলিশ। গ্রেফতার হয়েছিল ৩৩ জন জঙ্গি। তবে, পালিয়ে গিয়েছিল তাদের প্রশিক্ষক। আটক জঙ্গিদের জেরা করে জানা গিয়েছিল, জসিমউদ্দিন নামে ঢাকার মহম্মদপুরের জামেয়া রাহমানিয়া মাদ্রাসার এক শিক্ষক ওই প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছিল। ওই মাদ্রাসায় অভিযান চালিয়ে অবশ্য কাউকে পাওয়া যায়নি। ২০০৭ সালে জেএমবি প্রধান-সহ জামাতুলের আরও কয়েকজন নেতাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। ফলে, তাদের জঙ্গি তৎপরতা অনেকটাই চাপা পড়ে গিয়েছিল। এর পাঁচ বছর পর, ২০০৯ সালে জসিমউদ্দিনই গঠন করেছিল ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’। তারা গোপনে সদস্য সংগ্রহ করে গিয়েছে এবং তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশে শুরু হয় তাদের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড।
আনসারুল্লা বাংলা টিমের জঙ্গি কার্যকলাপ
বাংলাদেশ পুলিশ জানিয়েছে, বেশ কয়েকটি ধাপে নাশকতা চালায় এবিটি। শেষতম ধাপ হল, নিশানা করে হত্যা করা। যা এর আগে, বাংলাদেশের কোনও জঙ্গি সংগঠনের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। আহমেদ রাজীব হায়দার, আসিফ মহিউদ্দিন, অভিজিৎ রায়, ওয়াসিকুর রহমান, অনন্ত বিজয় দাস, একেএম শফিউল ইসলাম-সহ বহু বিশিষ্ট বাংলাদেশি নাস্তিক ব্লগারদের হত্যার দায় স্বীকার করেছে তারা। হত্যার আগে, তাদের হুমকি দেওয়া হত। শুধু তাই নয়, ২০২২-এর নভেম্বরে, ব্লগার অভিজিৎ রায়কে হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত দুই জঙ্গিকে ঢাকার একটি আদালত কক্ষ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল আনসারুল্লা বাংলা টিম।
নিষিদ্ধ ও নাম বদল
২০১৫ সালের মে মাসে, আনরুল্লাহ বাংলা টিমকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল তৎকালীন সরকার। সেই সঙ্গে, আনসার সদস্যদের ধরপাকড় শুরু হয়। তারও আগে, ২০১৩ সালের ১২ অগস্ট বরগুনা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল তাদের প্রধান জসিমুদ্দিন রাহমানিকে। নাস্তিক যুক্তিবাদী ব্লগার রাজীব হায়দার হত্যা মামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে, জসিমুদ্দিন রাহমানিকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিল বাংলাদেশি আদালত। তার সঙ্গে ধরা পডে়ছিল আনসারের ৩১ সহযোগীও। তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদ-সহ আরও চারটি মামলা দায়ের হয়েছিল। সম্প্রতি, সেই সবগুলি থেকেই তাকে মুক্তি দিয়েছে ইউনুস সরকার, আর হত্যা মামলায় জামিন। এদিকে, এবিটি নিষিদ্ধ হওয়ার পর সংগঠনটি ফের আত্মপ্রকাশ করে আনসার আল ইসলাম নামে। এই অবস্থায়, জসিমুদ্দিন রাহমানি মুক্তি পাওয়া যথেষ্ট চিন্তার
সুত্র: টিভি ৯ বাংলা