বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় সারা দেশে অনেক থানা থেকে অস্ত্র, গোলা-বারুদ লুট হয়৷ সারা দেশের ৬৩৯টি থানার মধ্যে অন্তত ৪৫০টি কমবেশি ‘আক্রান্ত’ হয়েছিল বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন। তখন তারা জানিয়েছিল, এই থানাগুলো থেকে অস্ত্র, গোলা-বারুদ লুট হয়েছে৷
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, ওই সময় সর্বমোট পাঁচ হাজার ৮১৭টি আগ্নেয়াস্ত্র খোয়া যায়৷ ১৮ শ’ ৯০টি অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি, যার মধ্যে রয়েছে, চায়না রাইফেল ২৯৬টি, রাইফেল ৮টি (বিডি) একটি, এসএমজি-টি ৫৬ (চায়না) ৬০টি, এলএমজি-টি ৫৬ (চায়না ১১টি, পিস্তল-টি ৫৪ (চায়না) ৮৩১টি, এসএমজি/এসএমটি একটি, ১২ বোর শটগান ৫৬৬টি, ৩৮ মি.মি. গ্যাস গান (সিঙ্গেল শট) ১১৭টি, টিয়ার গ্যাস লাঞ্চার (সিক্স শট) ৫টি এবং ২৬ মি.মি. সিগন্যাল পিস্তল দু’টি৷
গোলাবারুদের মধ্যে দুই লাখ ৯৫ হাজার ২২৭টি বিভিন্ন বোরের গুলি, বিভিন্ন ধরনের টিয়ার শেল ৮৮৭৮টি, সাউন্ড গ্রেনেড ২৫৬৪টি, কালার স্মোক গ্রেনেড ৭৮টি, সেভেন/মাল্টিপল ব্যাং স্টান গ্রেনেড ৩৭টি, ফ্ল্যাশ ব্যাং/৬ ব্যাং গ্রেনেড ৩৬০টি এবং হ্যান্ড হেল্ড টিয়ার গ্যাস স্প্রে (ক্যানিস্টার) ৮৩টি এখনো উদ্ধার হয়নি৷
উদ্ধার করা যায়নি স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ)-এর অত্যাধুনিক অ্যাসল্ট রাইফেল, স্নাইপার রাইফেল, এসএমজি টি-৫৬ রাইফেল, ফ্ল্যাশব্যাং গ্রেনেড, অ্যান্টি-ড্রোন সিস্টেম, বেতার যোগাযোগের ডিভাইস ও বিপুল গোলাবারুদ৷
লুট হওয়া অনেক অস্ত্র ও গোলাবারুদ এখনো উদ্ধারের অপেক্ষায় এমন এক সময়ে সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের কারামুক্তি নিরাপত্তা সংকট বাড়াতে পারে কিনা জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, যারা জামিনে মুক্তি পেয়ে বের হচ্ছে, তাদের বিষয়ে কিছু বলা যাবে না৷ কিভাবে তারা জামিন পাচ্ছেন সেটা আদালতের বিষয়৷ কিন্তু জেল ভেঙে যে জঙ্গিরা পালিয়েছে তারা তো অবশ্যই নিরাপত্তার জন্য হুমকি৷ এমনকি বিপুল পরিমান অস্ত্র ও গোলাবারুদ এখন যে উদ্ধার হয়নি সেটাও তো উদ্বেগের৷ এছাড়া গণভবন ও সংসদ ভবন থেকে এসএসএফের যে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র লুট হয়েছে, সেগুলো তো কোনোভাবেই সাধারণ নাগরিকের কাছে, এমনকি পুলিশের কাছেও থাকা উচিত নয়৷ এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ বাইরে থাকলে যে কোনো সময় আইন-শৃঙ্খলা পারিস্থিতির অবনতি হতে পারে বলে আশঙ্কা থেকে যায়৷
কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন অন্তত ৬ জন শীর্ষ সন্ত্রাসী৷ এদের প্রায় সবাই কমপক্ষে ১৫-২০ বছর ধরে কারাবন্দি ছিলেন৷ খুন, চাঁদাবাজি, ভাংচুর ও দখলবাজির অভিযোগে এদের সবার বিরুদ্ধেই ৭ থেকে ১৫টি মামলা রয়েছে৷ সব কটি মামলায় জামিন পাওয়ার পর একে একে তারা কারাগার থেকে মুক্তি পাচ্ছেন৷ সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাতে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন রাজধানীর পূর্ব রাজা বাজার এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী শেখ আসলাম, ওরফে সুইডেন আসলাম৷
কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারের জেলার লুৎফর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ২০১৪ সাল থেকে শেখ আসলাম কাশিমপুর কারাগারে বন্দি ছিলেন৷ তার জামিনের কাগজপত্র এলে তা যাচাই-বাছাই শেষে মঙ্গলবার রাতেই তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে৷
১৯৯৭ সালে সুইডেন আসলামকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ তার বিরুদ্ধে ২২টি মামলা ছিল৷ এর মধ্যে তেজগাঁও এলাকায় গালিব হত্যাসহ ৯টি হত্যা মামলা রয়েছে৷ ‘শীর্ষ সন্ত্রাসীদের’ মধ্যে আরো ৫ জন গত এক মাসে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন৷ তারা হলেন সানজিদুল ইসলাম ইমন, আব্বাস উদ্দিন ওরফে কিলার আব্বাস, টিটন, পিচ্চি হেলাল ও ফ্রিডম রাসু৷
গত ১৪ আগষ্ট ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ইমন মুক্তি পান৷ একই সময়ে ইমনের প্রধান সহযোগী মামুনও জামিনে মুক্তি পান৷ এর আগে ১২ আগষ্ট একই কারাগার থেকে মুক্তি পান ফ্রিডম রাসু ও পিচ্চি হেলাল ৷ রাসুর বিরুদ্ধে পুলিশ কর্মকর্তা হত্যাসহ ১৩টি মামলা রয়েছে৷ ২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর তেইশ শীর্ষ সন্ত্রাসী তালিকা প্রকাশের আগেই পিচ্চি হেলাল মোহাম্মদপুর থেকে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন৷ তার বিরুদ্ধে চারটি হত্যা মামলাসহ মোট ৮টি মামলা রয়েছে৷
তেইশ ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’র তালিকার ২ নম্বরে টিটনের নাম৷ ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকার একটি বাসা থেকে ডিবি অবৈধ পিস্তলসহ তাকে গ্রেপ্তার করে৷ গত ১২ আগষ্ট কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি জেল থেকে জামিনে মুক্তি পান টিটন৷ ১৩ আগষ্ট কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি জেল থেকে জামিনে মুক্তি পান আব্বাস উদ্দিন ওরফে কিলার আব্বাস৷ রাজধানীর কাফরুল, কচুক্ষেত ও ইব্রাহিমপুর এলাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন ছিলেন আব্বাস৷ তার বিরুদ্ধে ৬টি হত্যা মামলাসহ ১০টি মামলা বিচারাধীন৷ তবে এই ১০ টি মামলায় একে একে তিনি জামিন পান৷
‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’দের জামিনে মুক্তির বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, একজন মানুষ তো সারাজীবন কারাগারে থাকতে পারে না৷ আদালত যদি জামিন দেয়, তাহলে মুক্তিতে সমস্যা কী? জোর করে তো আর তাকে কারাগারে আটকে রাখা যাবে না৷ তবে, হ্যাঁ, কারাগার থেকে বের হওয়ার পর তার দিকে নজরদারি অবহ্যত রাখতে হবে৷ তিনি যদি অপরাধ জগৎ ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন তো ভালো কথা৷ কিন্তু তিনি যদি আবারও অপরাধ জগতে ফিরে যান, তাহলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আবারও তাকে গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করবে৷ কাউকে জোর করে কারাগারে আটকে রাখা ঠিক না৷
নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি)-র প্রধান মুফতি জসিম উদ্দীন রাহমানী কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন৷ গত রবিবার দুপুরে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগার থেকে জসিম উদ্দীন রাহমানীকে মুক্তি দেওয়া হয়৷ তিনি ব্লগার রাজীব হায়দার হত্যা মামলার পাঁচ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ছিলেন৷ সেই সাজা ভোগ করা হয়ে গেছে৷ এছাড়া আরো পাঁচটি মামলা বিচারাধীন রয়েছে৷ সেগুলোতে তিনি জামিন পেয়েছেন৷ ২০১৩ সালের ১২ আগস্ট বরগুনা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় রাহমানীকে৷ এরপর থেকেই তিনি কারাগারে ছিলেন৷ জঙ্গি তৎপরতা, সরকার ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে জসিম উদ্দিন রাহমানীর বিরুদ্ধে আরো পাঁচটি মামলা বিচারাধীন৷ সেগুলোতেও ইতিমধ্যে তিনি জামিন পেয়েছেন৷
এদিকে গত ৭ আগস্ট গাজীপুরের কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে বিক্ষোভের সময় কারারক্ষীদের জিম্মি করে ২০৯ জন বন্দি পালিয়ে যান৷ বন্দি পালানো ঠেকাতে গুলি ছোঁড়েন কারারক্ষীরা৷ এতে ছয় জন নিহত হয়৷ তাদের মধ্যে তিন জঙ্গিও ছিল৷ তিনজনই গুলশানে হোলি আর্টিজান বেকারিতে জিম্মি করে হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্ত আসামী ছিলেন৷ নিহত ছয় জন হলেন- হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা মামলার আসামি নরসিংদীর নলভাটা এলাকার জাকির হোসেনের ছেলে মো. জিন্নাহ (২৮), নওগাঁর কাঞ্চনপুর এলাকার আবদুস সালামের ছেলে আসলাম হোসেন মোহন, হোলি আর্টিজান মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আফজাল হোসেন (৬৩), হত্যা মামলার আসামি মৌলভীবাজারের রামেশ্বপুরের মকবুল মিয়ার ছেলে ইমতিয়াজ পাভেল (২৪), ছিনতাই মামলার আসামি টাঙ্গাইলের তারটিয়া এলাকার রাজ্জাক শেখের ছেলে স্বপন শেখ (৪০) ও সুনামগঞ্জের জলোশা এলাকার সিরাজুল ইসলামের ছেলে আয়াতুল্লাহ (৩৯)৷ পালিয়ে যাওয়া ২০৯ জনের মধ্যেও বেশ কয়েকজন জঙ্গি সদস্য রয়েছে বলে কারাসূত্রে জানা গেছে৷
এছাড়া গত ২০ জুলাই নরসিংদী জেলা কারাগারে হামলা চালিয়ে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে ৯ জঙ্গিকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় তাদের সহযোদ্ধারা৷ এদের মধ্যে চার জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ বাকি ৫ জন এখনো পলাতক৷ ওই সময় কারাগার থেকে বেশ কিছু অস্ত্র লুট হয়, পালিয়ে যায় প্রায় ৯ শতাধিক আসামি৷ লুট হওয়া ৮৫টি আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে ২০টি চায়না রাইফেল, ১৫টি রাইফেল এবং ১০টি শটগানসহ ৪৫টি অস্ত্র, এক হাজার ৯১টি গুলি উদ্ধার করা হয়েছে৷ এছাড়া ১৮৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ৷ পুলিশের সহায়তায় পালিয়ে যাওয়া ৪৮১ জন কয়েদি আত্মসমর্পণ করেছেন৷ এখনো পলাতক রয়েছেন বিভিন্ন মামলার প্রায় দুই শতাধিক আসামি৷
এসব আগ্নেয়াস্ত্র সাধারণ মানুষের কাছে থাকা নিরাপদ কিনা জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা ডয়চে ভেলেকে বলেন, অবৈধ কোনো আগ্নেয়াস্ত্র সাধারণ মানুষের কাছে থাকা ঠিক না৷ এর কারণে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে কোনো সময় অবনতি হতে পারে৷ এই মুহুর্তে সরকারের কাজ হবে এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারে মনোযোগ দেওয়া৷ পাশাপাশি যেসব সন্ত্রাসী ও জঙ্গিরা পালিয়ে গেছেন, তাদের গ্রেপ্তার করে আইনে সোপর্দ করা৷
সুত্রঃ ইত্তেফাক