২০২২ সালের ২০ নভেম্বর দিনে-দুপুরে ফিল্মি স্টাইলে জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে খোদ রাজধানী ঢাকায়। ঘটনার দেড় বছর পার হলেও সেই জঙ্গিদের গ্রেপ্তার তো করা যায়নি, মেলেনি কোনো সন্ধানও। পালানোর পর সেই দুই আসামিসহ অন্য আসামিদের কেন ডান্ডাবেড়ি ছাড়া আদালতে নেওয়া হয়েছিল তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে, নিরাপত্তা নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়।
তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, দুই জঙ্গি শামীম ও সোহেল দেশেই আছেন। তাদের ঘন ঘন অবস্থান পরিবর্তনের কারণে গ্রেপ্তার করা যাচ্ছে না। আর ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজন ভ্যান থেকে পালানো সালাউদ্দিন সালেহীন ভারতে নাকি বাংলাদেশে তা নিশ্চিত নয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্রের দাবি, সালেহীন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আত্মগোপন করেছেন।
জঙ্গি ছিনতাই ঘটনার তদন্ত সংশ্লিষ্ট সিটিটিসি কর্মকর্তাদের দাবি, শামীম ও সোহেলের অবস্থান নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে। তাদের ধারণা, এই দুজন দেশ থেকে পালাতে পারেনি। তাদেরকে কারা, কীভাবে, কয়জনের উপস্থিতিতে, কাদের নির্দেশে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে তা নিশ্চিত হওয়া গেছে।
ঢাকার আদালত চত্বর থেকে পলাতক দুই জঙ্গি মঈনুল হাসান শামীম ও আবু সাদিক সোহেল হলেন জাগৃতী প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন ও লেখক অভিজিৎ রায় হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। নিষিদ্ধ সংগঠন আনসার আল ইসলামে যুক্ত ছিলেন তারা।
জঙ্গি ছিনতাইয়ের ওই চাঞ্চল্যকর ঘটনায় কারো গাফিলতি ছিল কি-না, তা বের করতে তদন্ত কমিটি করেছিল পুলিশ সদর দপ্তর। সেই কমিটি কিছু সুপারিশও দিয়েছিল। কিন্তু সেসব সুপারিশ শুধুই কাগজে। দৃশ্যমান বাস্তবায়নে উদ্যোগ দেখা যায়নি।
এব্যাপারে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুই জঙ্গি পালানো দুঃখজনক। আমার আমলে এই দুই দুর্ধর্ষ জঙ্গি গ্রেপ্তার হয়েছিল। অথচ পুলিশ, কারা কর্তৃপক্ষের অবহেলা, দুর্বলতার কারণে তারা ফিল্মি স্টাইলে পালিয়ে গেল। যাদের গাফিলতি ছিল তাদের বিরুদ্ধে তো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা, সেটা নেওয়া হয়েছিল কি-না জানি না।
তিনি বলেন, এখন তারা (পলাতক জঙ্গি) তো হুমকি। যারা পালায় তাদের তো সংশোধন হবে সেটাও আশা করা যায না। বরং সহযোগীদের সঙ্গে মেশা বা যোগাযোগ করে সেই জঙ্গি কার্যক্রম চালানোর চেষ্টা করে। তারা দেশে নাকি পার্শ্ববর্তী দেশে পালিয়ে গেছে তা জানা নেই। তারা তো ফাঁসির আসামি। তারা গ্রেপ্তার না হওয়া পর্যন্ত সবার জন্যই বিষয়টি হুমকির।
যেভাবে ছিনতাই
দুই জঙ্গিকে ছিনতাইয়ের ঘটনাটি যখন ঘটেছিল, তখন তারা ছিলেন ঢাকার আদালতে কোর্ট পুলিশের হেফাজতে। একটি সন্ত্রাস বিরোধী আইনের মামলায় ১২ আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে চার জঙ্গি ছিলেন আনসার আল ইসলামের সশস্ত্র টিমের সদস্য। যারা প্রকাশক দীপন ও লেখক অভিজিৎকে কুপিয়ে হত্যায় সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন।
চারজন চারজন করে আসামিদের কোর্ট থেকে গারদে নেওয়া হচ্ছিল। প্রথম চারজনের মধ্যে ছিল জঙ্গি সদস্য আরাফাত, সবুর, মইনুল হাসান শামীম ও আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব। তখনই অতর্কিতভাবে পুলিশের ওপর আক্রমণ করে সহযোগীদের ছিনিয়ে নিতে আসে অন্য জঙ্গিরা। তারা রাস্তার বিপরীতে মোটরসাইকেল পার্ক করে দাঁড়িয়ে ছিল। গেটে আসা মাত্র পিপার স্প্রে নিক্ষেপ করে অজ্ঞান করা হয় পুলিশ সদস্য, গেটম্যান ও তিন চালককে। এরপর পুলিশ ও আনসার সদস্যকে কিল-ঘুষি মেরে একটি বাইকে দুই জঙ্গিকে তুলে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে অন্যরা।
ছিনিয়ে নিতে আসা জঙ্গিরা পলায়নের রুটম্যাপ ও ব্যাকআপ নিয়েই ঘটনাস্থলে এসেছিল। তারা জানত, এখানে সিসিটিভি ক্যামেরা নেই। ধারণা করা হচ্ছে তাদের সর্বোচ্চ প্রস্তুতি ছিল। একাধিক জঙ্গি সদস্য এই ছিনিয়ে নেওয়ার অপারেশনে যুক্ত ছিল। সঙ্গে আনা কাঁধব্যাগে বিস্ফোরক ও আগ্নেয়াস্ত্রও আনা হয়েছিল বলে ঘটনার পর জানায় সিটিটিসি। মোটরসাইকেলে জঙ্গিদের পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য আশপাশের সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়লেও দেড় বছরেও তাদের সন্ধান মেলেনি।
দুই জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় ২০ জনকে আসামি করে মামলা করেন আদালত পুলিশের পরিদর্শক জুলহাস উদ্দিন আকন্দ। সেই মামলাটি তদন্ত করছে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট।
পুলিশ ও আদালত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, দুই জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার মামলায় এখন পর্যন্ত সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস ওমর ফারুক, তার স্ত্রী তানজিলাসহ ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা সবাই এখন কারাগারে।
একাধিক অভিযানেও ধরা পড়েনি লাপাত্তা দুই জঙ্গি।
দুই জঙ্গিকে পালাতে সহায়তা করেন সুরঞ্জিতের সাবেক এপিএস ফারুক
জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনা তদন্তে পুলিশ সদর দপ্তরে গঠিত কমিটি প্রয়াত মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সাবেক এপিএস ওমর ফারুক তালুকদারকে এই কাজের ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ফারুকের শ্যালক হলেন ছিনিয়ে নেওয়া জঙ্গি আবু সাদিক সোহেল।
প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সাবেক এপিএস ওমর ফারুক তালুকদার ও তার স্ত্রী তানজিলাকে ২০২২ সালের ২০ ডিসেম্বর গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরদিন ওমর ফারুককে আদালতে তুলে ১৫ দিন রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন জানানো হয়।
পুলিশের পক্ষ থেকে সেদিন লিখিতভাবে আদালতের কাছে দাবি করা হয়, দুর্নীতির মামলায় ২০১২ সালে ওমর ফারুক যখন কারাগারে ছিলেন, তখন তিনি জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন। আবু সিদ্দিকের বোনকে বিয়ে করে আনসার আল ইসলাম নামের সংগঠনকে নানাভাবে সহযোগিতা করেন। আইনজীবী পেশার আড়ালে তিনি জঙ্গিদের সহযোগিতা করেছেন। আদালত থেকে শ্যালক আবু সিদ্দিককে ছিনিয়ে নিতে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেন। ওমর ফারুকের মোবাইল ফোনের খুদে বার্তা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, তার প্রথম স্ত্রী তাকে জঙ্গি আখ্যায়িত করেছিলেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তদন্ত করতে গিয়ে দুবাইয়ের একটি হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর পেয়েছেন। ওই নম্বর ব্যবহার করেই কারাগারে সোহেলের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন ফারুক। সেই নম্বরে ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করা হয়।
১৪ দফা সুপারিশ শুধু কাগজেই
জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় পুলিশের গাফিলতি ছিল কি না, কিংবা নিরাপত্তা ত্রুটি খতিয়ে দেখতে পুলিশ সদর দপ্তর একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করেছিল। তদন্ত শেষে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনের অধিক ঝুঁকিপূর্ণ জঙ্গিদের জন্য আলাদা প্রিজন ভ্যান, অনলাইনে হাজিরা নেওয়া, জেলখানা পরিবর্তন এবং ডিএমপির প্রসিকিউশন বিভাগে পদায়নের আগে পুলিশের প্রাক-পরিচয় যাচাইসহ ১৪ দফা সুপারিশ বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছিল পুলিশ সদর দপ্তর।
২০২৩ সালের ৩০ আগস্ট পুলিশ সদর দপ্তরের গঠিত কমিটির সুপারিশগুলো উল্লেখ করে সেগুলো বাস্তবায়ন করতে চিঠি দেন পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি (অপারেশন্স) নাসিয়ান ওয়াজেদ।
এই চিঠি মেট্রোর পুলিশ হেডকোয়ার্টাসের কিছু বিশেষায়িত সেল, কমিশনার, রেঞ্জের ডিআইজি ও পুলিশ সুপারদের কাছে পাঠানো হয়। একইসঙ্গে এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে সব ইউনিটকে জানাতে বলা হয়।
সুপারিশে বলা হয়, এটিইউ, সিটিটিসি, এসবি, সিআইডি, যেসব পুলিশ ইউনিট কাউন্টার টেররিজম নিয়ে কাজ করে—এসব ইউনিটের এ সংক্রান্ত গোয়েন্দা কার্যক্রম সমন্বয়ের লক্ষ্যে পুলিশ সদর দপ্তরে একটি সেল গঠন করা যেতে পারে। এই সেল নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন সংক্রান্ত পুলিশি কার্যক্রম যেমন- গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, অপারেশন, গ্রেপ্তার, তদন্তে সহায়তা, প্রসিকিউশন বিভাগকে সহায়তা ও আসামি পরিবহনের যাবতীয় কর্মকাণ্ড সমন্বয় করবে।
জেল কোড ও আদালতের নির্দেশ প্রতিপালন সাপেক্ষে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ আসামিদের কাশিমপুর কারাগারের পরিবর্তে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে (দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ) রাখা যেতে পারে।
এছাড়া, ডিএমপির প্রসিকিউশন বিভাগে পদায়নের ক্ষেত্রে পুলিশ সদস্যদের প্রাক-পরিচয় যাচাই এবং ত্রৈমাসিক ভেটিং করা যেতে পারে। আসামি ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত প্রসিকিউশন বিভাগে একটি সফটওয়ার ডেভেলপ করা যেতে পারে।
কারাগারে আসামি প্রবেশের সময় এবং কারাগার থেকে বের করার সময় পুলিশ ও কারারক্ষীদের যৌথ টিম আসামিদের দেহ তল্লাশি নিশ্চিত করবে।
শীর্ষ সন্ত্রাসী, জঙ্গি, দুর্ধর্ষ প্রকৃতির বন্দিদের আদালতে এবং অন্যত্র স্থানান্তরের সময় প্রিজন ভ্যান দিয়ে যথাযথ নিরাপত্তা সঙ্গে পরিবহন করা যেতে পারে। অন্য কোনো গণপরিবহনে এ ধরনের স্পর্শকাতর আসামি পরিবহন করা যাবে না।
প্রতিটি প্রিজন ভ্যানে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা যেতে পারে এবং এতে করে প্রিজন ভ্যানের অভ্যন্তরে আসামিদের গতি-প্রকৃতি মনিটরিং করা সম্ভব হবে। নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গিদের স্বতন্ত্র প্রিজন ভ্যানে পরিবহন করা যেতে পারে।
ডিএমপির সিএমএম কোর্টের হাজতখানা ইনচার্জ হিসেবে বর্তমানে একজন সাব-ইন্সপেক্টর (এসআই) দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত। তার পরিবর্তে সিএমএম ও মহানগর দায়রা জজ আদালতের হাজতখানায় ইনচার্জ হিসেবে অন্যূন একজন সহকারী পুলিশ কমিশনার পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে পদায়ন করা যেতে পারে। অন্যান্য ইউনিটে হাজতখানা ইনচার্জ হিসেবে এসআই পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে পদায়ন করা যেতে পারে। আসামি পরিবহন বা গমনাগমনের জন্য ঢাকার সিজেএম ভবনের উত্তর দিকের সিএমএম হাজতখানা সংলগ্ন গেটটি ব্যবহার করা যেতে পারে।
সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি সংশোধনপূর্বক ঝুঁকিপূর্ণ এবং সাজাপ্রাপ্ত বা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ক্ষেত্রে আদালতে অনলাইন হাজিরা নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। এছাড়া আদালতে আরও সিসি ক্যামেরা স্থাপন, আসামির স্কর্ট দেওয়া এক গ্রুপ থেকে অন্য গ্রুপের পুলিশ সদস্যদের মধ্যে সমন্বয়, আদালতের ডিউটির আগে উত্তমভাবে ব্রিফিং ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে সুপারিশে।
পুলিশ ও কারা সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ও দণ্ডপ্রাপ্তসহ বিভিন্ন নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের প্রায় ৫০ জঙ্গি রয়েছেন। কারাগারের বিশেষ সেলে তাদের আলাদাভাবে রাখা হয়। এছাড়া চট্টগ্রাম কারাগারে রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির জঙ্গিদেরও রাখা হয়।সুত্রঃ ঢাকা পোষ্ট