এক সপ্তাহ আগে ঢাকার পান্থপথ মোড়ে যে অনাকাঙ্ক্ষিত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে তা এখনো ভুলতে পারছেন না তরুণ চলচ্চিত্রনির্মাতা ও নারী অধিকার কর্মী অপরাজিতা সঙ্গীতা।
মোড়ের পাশে তিনি যখন সিগনালের জন্য গাড়িতে অপেক্ষা করছিলেন ঠিক তখনই একজন বয়স্ক ব্যক্তি ওড়না ছাড়া পোশাক পরায় তাকে গালাগাল শুরু করেন। তবে এই কাজ করেই ক্ষান্ত হননি তিনি। অপরাজিতা এক পর্যায়ে গাড়ির জানালার কাঁচ তুলে দেওয়ায় ওই লোকটি আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। এই ঘটনাটির ভিডিও ধারণ করতে মোবাইল ফোনের ক্যামেরা চালু করতেই গাড়ির জানালায় থুতু দিয়ে চলে যান তিনি।
ওই ঘটনার কথা বলতে গিয়ে অপরাজিতা জানান, লোকটি এতটাই আক্রমণাত্মক ছিলেন যে মনে হচ্ছিল গাড়ির জানালাই ভেঙে ফেলবেন।
‘শুধুমাত্র ওড়না না থাকায় এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার কথা কখনো কল্পনাও করতে পারিনি। সেটাও আবার আমার নিজের গাড়িতে বসে। মনে হলো লোকটি যেন আমার মুখেই থুতু দিয়ে গেছেন।’
এর পরই গাড়ি থেকে নেমে নিজের মুখ ধুয়ে ফেলেন অপরাজিতা।
বেশ কিছুদিন ধরেই অনেক নারী এভাবে পথেঘাটে হয়রানির মুখোমুখি হওয়ার কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করছেন। গত ৫ আগস্ট দেশে পট পরিবর্তনের পর থেকেই এ ধরনের ঘটনা ব্যাপকভাবে বেড়েছে বলে তারা জানাচ্ছেন।
অধিকারকর্মীরা বলছেন, রাস্তায় পুলিশের উপস্থিতি কম থাকায় একশ্রেণির মানুষ নির্ভয়ে এই অপরাধগুলো করছেন। তাদের কাছে নারীরা সহজ টার্গেট।
শুধু রাজধানীতেই নয় দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকেও পথেঘাটে একই কায়দায় হয়রানির ঘটনার কথা তুলে ধরছেন নারীরা। নারীদের সরাসরি চলাচলে বাধা দেওয়া, বাজে মন্তব্য করা এমনকি কিছু ক্ষেত্রে শারীরিক ও যৌন হয়রানির ঘটনাও ঘটছে।
গত মাসে, দেশের বিশিষ্ট পর্বতারোহী শায়লা বীথি ধানমন্ডির একটি ফুটওভার ব্রিজ পার হওয়ার সময় প্রকাশ্য দিবালোকে একদল পুরুষের দ্বারা শারীরিকভাবে আক্রান্ত হন। হামলায় আহতও হন তিনি।
গত মাসের মাঝামাঝি সময়ে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে দুই নারীকে মারধর ও হয়রানির ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনার কয়েকটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।
একই কায়দায় ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় যৌনকর্মীদের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটে।
সিনিয়র সাংবাদিক ঝর্ণা রায় জানান, স্ট্রিট ফুডের দোকানে পরিবারের সঙ্গে খাবার খাওয়ার সময় হিজাব না থাকায় হয়রানির মুখে পড়তে হয় তাকে।
পথেঘাটে নারীদের প্রতি একশ্রেণির পুরুষের বৈষম্যমূলক আচরণে বাড়বাড়ন্তের মধ্যেও সঙ্গীতা ও ঝর্ণার মতো নারীরা প্রতিবাদ করার সাহসও হারিয়ে ফেলছেন। কারণ প্রতিবাদ করলে আশপাশের লোকজনের সমর্থন পাওয়া তো দূরের কথা বরং তারা এখন হামলার মুখে পড়ার আশঙ্কাও করছেন।
সঙ্গীতা বলেন, এরকম ক্ষেত্রে আমি সব সময় প্রতিবাদ জানিয়ে এসেছি। আমার সিনেমা সব সময় নারী স্বাধীনতার কথা বলে। কিন্তু সেদিন আমি প্রতিবাদ করতে পারিনি। আমার আশঙ্কা ছিল ওই লোকের বয়সের কারণে আশপাশের মানুষ হয়ত আমার কথা বিশ্বাস না-ও করতে পারে।
সামাজিক মাধ্যমে নারীরা জানাচ্ছেন, দূর থেকে ছুড়ে দেওয়া কটু মন্তব্য, অসৌজন্যমূলক কথাসহ বিভিন্নভাবে হয়রানির ঘটনা বেড়েই চলেছে। একজন নারী জানান, কপালে টিপ পরার জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে তাকে। আরেকজন জানান, চাকরির জন্য সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে বোরকা না পরার কারণে হয়রানির শিকার হতে হয় তাকে। আরও অনেকেই পথে চলার সময় কটুকথা শোনার অভিজ্ঞতার কথা জানান।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়ার পরও কেন এই পরিস্থিতির উন্নতি হলো না তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নারী অধিকার কর্মী এবং নিজেরা করি’র সমন্বয়কারী খুশী কবির।
তিনি বলেন, সরকারের উপদেষ্টারা কেন এই ঘটনাগুলোর নিন্দা জানিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলছেন না সেটা আমার বোধগম্য নয়। যে সংখ্যায় ঘটনাগুলো ঘটছে তাতে সরকারের নীরবতা গ্রহণযোগ্য নয়।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, শাস্তি না হওয়ায় দেশের অতি রক্ষণশীল গোষ্ঠীগুলো এসব কাজ করার সাহস পাচ্ছে। নারীদের হয়রানির ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার ফল হিসেবে অনলাইনেও নারীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে।
সুত্রঃ দ্যা ডেইলী ষ্টার বাংলা