সংগৃহীত ছবি
সম্প্রতি কালেমা খচিত কালো পতাকা নিয়ে মিছিলের কিছু ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এসব মিছিল থেকে ফিলিস্তিনে গণহত্যা বন্ধ, ইসলামের নবী মুহাম্মদকে কটূক্তির প্রতিবাদ কিংবা কেউ ইসলামি খেলাফত কায়েমেরও দাবি তুলতে দেখা গেছে। এই পতাকা নিয়ে মিছিল করায় আটকের ঘটনাও ঘটেছে। এতে একদিকে যেমন সমালোচনা হচ্ছে অন্যদিকে কালো পতাকা নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে দিচ্ছেন অনেকেই।
এসব ছবি ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা শেয়ার করছেন তাদের কেউ কেউ দাবি করছেন, এই পতাকা ইসলামি জঙ্গিগোষ্ঠীর। বাংলাদেশে ইসলামি খেলাফত কায়েম করতেই এই পতাকা নিয়ে মিছিল করছে। তবে, আরেকটি পক্ষ এটিকে সন্দেহের চোখে দেখছেন। তাদের বক্তব্য কোন রাজনৈতিক ইন্ধনেই এসব করা হয়ে থাকতে পারে। যারা কালো পতাকা নিয়ে মিছিল করছে, তাদের উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন করছেন অনেকে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, যারা কালো পতাকা নিয়ে মিছিল করছে তারা নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন হিযবুত তাহ্রীরের সদস্য। এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ বা ডিএমপি কমিশনার মাইনুল হাসান বলেন, “হিযবুত তাহ্রীর নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার কারণে তারা প্রকাশ্যে মাঠে নামতে পারছে বলেই অতর্কিতভাবে নামার চেষ্টা করছে। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলছে”।
এর আগে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে শুক্রবার জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে থেকে একটি মিছিল বের করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। ওই মিছিল তিনজনকে আটক করা হয়। রোববারও রাজধানীর কয়েকটি কয়েক জায়গায় স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের কালো পতাকা নিয়ে মিছিল করতে দেখা গেছে। রোববার ঢাকার জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে এমন একটি মিছিল দেখা যায়। সেই মিছিল বের করে সেখানকার একটি স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা। ‘সচেতন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীবৃন্দ, সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল’ ব্যানার নিয়ে এই মিছিলটিতে বিভিন্ন শ্লোগান ও প্ল্যাকার্ড ও কালেমা লেখা পতাকা ছিল। তাদের হাতে বাংলাদেশের পতাকা, ফিলিস্তিনের পতাকা এবং কালেমা লেখা পতাকাও ছিল। তারা যে ব্যানার নিয়ে মিছিল করছিল সেখানে লেখা ছিল ইসলামের নবীকে ভারতীয় পুরোহিত কর্তৃক কটূক্তি ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের জবাবে তাদের প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল। সেই মিছিলে তাদের শ্লোগান দিতে শোনা যায়, ‘মুক্তির এক পথ, খিলাফত-খিলাফত’, ‘তুমি কে আমি কে, মুসলমান-মুসলমান’।
গত সপ্তাহে ঢাকার নটরডেম কলেজ, ঢাকা কলেজ উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের শিক্ষার্থীরা রাজধানীতে আলাদা আলাদা মিছিল বের করতে দেখা যায়। যেখানে তাদের কারো কারো হাতে বিশাল কালেমা লেখা কালো পতাকা দেখা যায়। কেউ কেউ আবার কাল কাপড়ে কালেমা লেখা পতাকা নিয়েও মিছিল করতে দেখা যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে অনেককেই এ নিয়ে নানা সমালোচনা করতেও দেখা গেছে।
এরই মধ্যে গত শুক্রবার কিশোরগঞ্জের একটি মিছিলের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ইসলামের নবীকে কটূক্তির প্রতিবাদে তৌহিদি জনতার ব্যানারে কিশোরগঞ্জ শহীদি মসজিদ থেকে ওই মিছিলটি বের হয়েছিল বলে জানান স্থানীয় সাংবাদিক নূর মোহাম্মদ। তিনি বলেন, “ওই মিছিল থেকে কেউ কেউ নবীজির কটূক্তির প্রতিবাদ ছাড়াও ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার দাবিতে শ্লোগান দিচ্ছিল। এই মিছিলে কিছু লোক ঢুকে গিয়েছিল, তাদের কারো কাছে কালো পতাকা, গলায় কালারফুল মাফলারও পরিহিত ছিল”।
ওই মিছিলে ব্যবহার হওয়া কালেমা লেখা কালো পতাকার বাইরেও একটি ভিন্ন রকমের পতাকার বিষয়টি নিয়েও নানা আলোচনা দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ফ্যাক্ট চেকার কদরুদ্দিন শিশির ওই ভিডিওর তথ্য যাচাইয়ে পর ফেসবুকে ভিডিও থেকে নেয়া একটি ছবি শেয়ার করে জানান, ওইদিন সেই মিছিলে কথিত ইসলামিক স্টেট বা “আইসিসের’র পতাকা উড়ানো হয়েছে।
তিনি বলেন, “কিশোরগঞ্জের মিছিলে কালো কালেমার পতাকার বাইরেও একটি আলাদা পতাকা ব্যবহার হয়েছে যেটি সম্পূর্ণ আলাদা। এই পতাকা শুধুমাত্র আইসিস’ই ব্যবহার করে থাকে। যেটির সাথে জঙ্গিগোষ্ঠী আল কায়েদার পতাকারও মিল রয়েছে”।
গত কয়েকদিন ঢাকায় যারা কালেমা লেখা কালো পতাকা নিয়ে যারা মিছিলে অংশ নিয়েছেন তাদের বেশিরভাগই ঢাকার নামীদামী স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী। তবে কিশোরগঞ্জের মিছিলে কারা কথিত ‘আইসিস’র পতাকা ব্যবহার করেছে সেটি এখনো শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ।
তবে কালেমা লেখা পতাকা নিয়ে যেসব মিছিল বের হয়েছে, সেখান থেকে অনেককেই ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠার দাবিতে শ্লোগান দিতে দেখা গেছে। এর আগে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর একই রকম পতাকা নিয়ে ঢাকায় কর্মসূচি পালন করতে দেখা গেছে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন হিযবুত তাহ্রীরকে।
এসব পতাকার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সাইফুল আলম চৌধুরী বলেন, “সাম্প্রতিক মিছিল গুলোতে কালেমা তাইয়্যেবা ও আইএস’র পতাকা প্রদর্শন করতে দেখা গেছে। দুইটা পতাকাই কালো রংয়ের”।
আগে বাংলাদেশে খুব কমই এই ধরনের পতাকার প্রদর্শন দেখা গেলও এখন হঠাৎ কেন এটি বেড়েছে সেই প্রশ্ন তুলেছেন মি. চৌধুরী।
খেলাফত ও জঙ্গিবাদ গবেষকদের মতে, ইসলামের নবীর যুগে কোন নির্দিষ্ট পতাকা ইসলামের প্রতীক হিসেবে পরিচিতি পায় নি কিংবা ইসলামের নির্দিষ্ট কোন পতাকাও কখনো ছিল না।
ইতিহাসের উদাহরণ টেনে তারা বলছেন, নবী মুহাম্মদের পরবর্তী খেলাফাতের জামানায় কালেমা লেখা কালো পতাকা ব্যবহার করতে দেখা গিয়েছে কোথাও কোথাও।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শাফি মো. মোস্তফা বলেন, “সাম্প্রতিক সময় এই পতাকা ব্যবহার করতে দেখি কথিত ইসলামিক স্টেট বা আইসিস গোষ্ঠীকে। সুতরাং বাংলাদেশে এখন এই ধরনের পতাকার ব্যবহার করলে এক ধরনের ট্যাগিংয়ের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা থাকবেই”। তবে, বিশ্লেষকরা এই পতাকার সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক আছে বলেও মনে করছেন না।
কালেমার কালো পতাকা নিয়ে মিছিলের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা ধরনের আলোচনা সমালোচনার পর তৎপর হয় পুলিশ। এই মিছিলে অংশ নেয় এমন তিনজনের কাছে হাতে কালো পতাকা, মাথায় পাগড়ি ছিল। পরে তাদেরকে আটক করে পুলিশ। একই দিন অভিযান চালিয়ে আটক করা হয় নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহ্রীরের মিডিয়া সমন্বয়ক ইমতিয়াজ সেলিমকে।
ডিএমপি কমিশনার মাইনুল হাসান বলেন, “এতদিন বিভিন্নভাবে আড়ালে আবডালে থাকার পর এখন তারা মাঠে আসার চেষ্টা করছে। আমরাও আমাদের আইনি ব্যবস্থা নিশ্চিত করছি। তবে এসব সংগঠনকে প্রতিহত করতে হলে সাধারণ মানুষকেও এগিয়ে আসতে হবে”।
সূত্র: বিবিসি বাংলা।