যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যের ব্যাটন রুজ শহরে গুলি করে তিন পুলিশ হত্যার দায় স্বীকারকারী এক কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন নাগরিক- যিনি নিজেও পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন- ঘটনার আগে এক ভিডিও বার্তায় তিনি দাবি করেছেন, কোনও জঙ্গিগোষ্ঠীর পক্ষ হয়ে নয়- বরং ন্যায়বিচার না পাওয়ায় তিনি প্রতিশোধ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। গভিন লং নামে কৃষ্ণাঙ্গ এই মার্কিনি একসময় মেরিন সেনা হিসেবে মার্কিন সামরিক বাহিনীতে কাজ করতেন।
যে শহরে তিনি তিন পুলিশ সদস্যকে গুলি করে হত্যা করেছেন এবং নিজেও নিহত হয়েছেন, সেই শহরে ঘটনার সপ্তাহ দুয়েক আগে অ্যাল্টন স্টারলিং নামে এক কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিনি পুলিশের গুলিতে নিহত হন। পুলিশের গুলিতে মিনেসোটায় নিহত হন আরেক কৃষ্ণাঙ্গ। এ দুটি ঘটনার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিভিন্ন স্থানে পুলিশবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের গুলিতে কৃষ্ণাঙ্গদের খুন হওয়া এবং এর প্রতিক্রিয়ায় পুলিশের ওপর হামলার খবর প্রায়ই গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়। বাস্তবতা হলো- এসব হামলার সঙ্গে আইএস -আল কায়েদার মতো আন্তর্জাতিক কোনও জঙ্গিগোষ্ঠীর সম্পর্ক থাকে না। মানুষের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই এসব হত্যাকাণ্ড হয়ে থাকে। এখন আপনি যদি গভিন লংকে জঙ্গি বলে আখ্যা দেন, তাহলে এই প্রশ্নটিও করতে হবে যে, তিনি কেন এই জঙ্গিবাদের পথ বেছে নিলেন? এই ঘটনার সঙ্গে মিল রেখে আপনাকে আরও প্রশ্ন করতে হবে, একসময় যেমন বলা হতো যে শুধু মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাই চরমপন্থা বা জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকছে- সেখানে এখন ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরাও কেন জঙ্গিবাদের মতো প্রাণঘাতি পথে পা বাড়াচ্ছে? এটি কি শুধু মগজধোলাইয়ের ব্যাপার নাকি এর পেছন এমন কোনও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া রয়েছে, যার জন্য এই সমাজ ও রাষ্ট্রও বহুলাংশে দায়ী?
একটা সময় পর্যন্ত এরকমটি ধারণা করা হতো যে, আর্থিক বা সামাজিক বঞ্চনার শিকার মানুষেরাই নিজেদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে। কিন্তু এই যুক্তিও এখন ধোপে টেকে না। কারণ আর্থিকভাবে স্বচ্ছল এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কাঠামোর ভেতরে থাকা পরিবারের সন্তানরাও জঙ্গি হচ্ছে। তার মানে এই ক্ষোভের শেকড় আরও গভীরে। এখানে শুধু আর্থিক বা সামাজিক বঞ্চনাই মূল অনুঘটক নয়।
মানুষের জঙ্গি হওয়ার পেছনে কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করা যেতে পারে।
১. ন্যায় বিচারের সংকট: লুইজিয়ানায় পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক গভিনের ভিডিওবার্তার দিকে খেয়াল করলে দেখা যাবে সেখানে তিনি বলেছেন, কোনও জঙ্গিগোষ্ঠীর হয়ে নয় বরং ন্যায়বিচার না পাওয়ায় তিনি এই হামলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তার মানে, মানুষের জঙ্গি হওয়া বা এরকম খুনি হওয়ার পেছনে ন্যায়-বিচারের সংকট বা অনুপস্থিতি একটা বড় কারণ। অর্থাৎ যে সমাজে ন্যায়-বিচার নেই বা বেশিরভাগ মানুষ যদি মনে করে তারা ন্যায়-বিচার পাচ্ছে না এবং গুটিকয় মানুষের জন্যই পুরো বিচারব্যবস্থা; যদি এরকম একটি ধারণা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় যে, এই রাষ্ট্রে যার রাজনৈতিক ক্ষমতা ও পয়সার দাপট আছে, কেবল তারাই ন্যায়-বিচার পাবে-তাহলে সেই সমাজে জঙ্গিবাদ বিস্তৃত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। সেই সমাজ ও রাষ্ট্রের একটি অংশ নিজেদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে সশস্ত্র হয়ে উঠতে পারে।
২.বর্ণবাদ: যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই নিজেদের মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের সোল এজেন্ট বলে দাবি করে। কিন্তু এই একুশ শতকেও সেখানে সাদা-কালোর যে বিভেদ, যেরকম বর্ণবাদ এবং যার প্রতিক্রিয়া প্রায়শই দেখানো হয় অস্ত্রের ভাষায়-সেখানে বঞ্চিত এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ভেতরে এরকম একটি প্রতিক্রিয়া তৈরি হতে বাধ্য যে, এই রাষ্ট্র তাদের জন্য নিরাপদ নয়। এই রাষ্ট্রব্যবস্থায় তারা ন্যায় বিচারবঞ্চিত- তখন সেখানে গভিনের মতো লোকেরা সশস্ত্র হলে তার দায় কার? বস্তুত সব নাগরিকের জন্য একটি সমান, মর্যাদাপূর্ণ ও ভারসাম্যপূর্ণ রাষ্ট্র গড়ে তোলার দায়িত্ব সরকারের। সরকার সেখানে ব্যর্থ হলে এর প্রতিক্রিয়া আসতে বাধ্য।
৩.পশ্চিমের দায়: মধ্যপ্রাচ্যে আইএস-এর মতো কট্টরপন্থি গোষ্ঠীর জন্মের পেছনে পশ্চিমাদের কি কোনও দায় নেই? এখন ইসলাম নামধারী এসব সশস্ত্র সংগঠন যখন বলে যে, তারা সারা বিশ্বে মুসলমানদের ওপর নিপীড়নের প্রতিশোধ হিসেবে খ্রিস্টানদের মারছে- তখন তার কী জবাব থাকে? যুক্তরাষ্ট্র কি পুরো ইরাক ধ্বংস করেনি? সিরিয়া-লিবিয়া-মিশরের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়নি? তাহলে সেখানে যদি যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য কোনও সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠী তৈরি হয়- তাতে অবাক হওয়ার কী থাকে?
এখন কথা হচ্ছে, আইএস –আল কায়েদা বা আলশাবাবের মতো সংগঠনগুলো আসলেই মুসলমানদের পক্ষে তথা পশ্চিমাদের ওপর প্রতিশোধ নিতেই গড়ে উঠেছে নাকি পশ্চিমারাই নিজেদের স্বার্থে এসব সংগঠন তৈরিতে ইন্ধন দিয়েছে- তা নিয়েও অনুসন্ধান চলছে। আইএস সৃষ্টির পেছনে ইসরায়েলের প্রত্যক্ষ মদদ রয়েছে- এরকম খবরও এখন শোনা যাচ্ছে।
৪. উদ্বুদ্ধকরণ: কিন্তু যেভাবেই এসব জঙ্গি সংগঠন গড়ে উঠুক না কেন, সেখানে লোক ভেড়ানোর জন্য মূলত যা দরকার তা হলো উদ্বুদ্ধকরণ- যেখানে ন্যায়বিচারের সংকট, আর্থিক ও সামাজিক বঞ্চনা একটা বড় ভূমিকা পালন করে। কারণ কোনও একটা ক্ষোভ বা আদর্শ ছাড়া এসব সংগঠন গড়ে ওঠে না।
৫. বিচ্ছিন্নতাবোধ: মানুষের জঙ্গি হয়ে ওঠার পেছনে একটা বড় ভূমিকা পালন করে বিচ্ছিন্নতাবোধ। যে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরা জঙ্গিবাদে ঝুঁকেছে বা ঝুঁকছে, অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে পরিবারের সঙ্গে তাদের বিচ্ছিন্নতা রয়েছে বা ছিল। কেবল অর্থবিত্ত, চাহিবামাত্রই দামি গাড়ি কিংবা আইফোন পেয়ে যাওয়া তারুণ্যের মনের কোনে হয়তো এমন কিছু চাওয়া থাকে, যেদিকে অর্থবিত্ত আর সোশ্যাল স্ট্যাটাসের পেছনে ছোটা ব্যস্ত মা বাবা খেয়ালই করেন না। এভাবে হয়তো তার ভেতরে একরকম বিচ্ছিন্নতাবোধ তৈরি হয়। ঘরের ভেতরে থেকেও সে হয়তো একা হতে থাকে। সে তখন নতুন কারও সঙ্গ চায়। তার সেই শূন্যতা যদি কখনও কোনও জঙ্গিগোষ্ঠী পূরণ করে, তখন আর তার পেছনে ফিরে তাকানোর সুযোগ হয় না।
নামি-দামি স্কুল, কলেজ, ভার্সিটিতে সন্তানকে পড়ালেও সে নৈতিক শিক্ষা কতটুকু শিখছে, মানুষকে মানুষ হিসেবে সে মর্যাদা দিতে পারছে কী না, মানবিক গুণাবলি সে শিখছে কী না-সেদিকে যদি অভিভাবকরা খেয়াল করতে না পারেন; সন্তান কখন ঘর থেকে বের হচ্ছে কখন ফিরছে, তার সঙ্গী কারা, ফেসবুকে সে কী করে, মোবাইল ফোনে কার সঙ্গে বেশি কথা বলেন- এসব খেয়াল করতে না পারলে সন্তান বিপথে যাবে- এতে আর বিস্ময়ের কিছু নেই।
৬. তথ্যপ্রযুক্তি: তথ্যপ্রযুক্তিতে আসক্ত তরুণরা কখন কার দ্বারা প্রভাবিত বা প্ররোচিত হয়- তা বলা মুশকিল। দেখা যাচ্ছে, জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়া তরুণদের প্রাথমিক আগ্রহ তৈরি হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই।
৭. বেহেশতের লোভ: বেহেশত-দোজখ সম্পর্কে অজ্ঞতাও স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে এই ভুল পথে পা বাড়াতে সহায়তা করতে পারে। ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলো ক্ষমতায় যেতে বা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য কর্মী সংগ্রহে নানা কৌশল অবলম্বন করে। সেই কৌশলে পড়ে গিয়েও অনেক শিক্ষার্থী কোনও জঙ্গি সংগঠনের ফাঁদে পড়ে যেতে পারে। মরে গেলেই শহীদ এবং বেহেশত নিশ্চিত- এরকম খুব স্পর্শকাতর তত্ত্বের দ্বারা খুব সহজেই শিক্ষার্থীরা প্রভাবিত হতে পারে।
৮. রোমান্টিসিজম: সব মানুষের মধ্যেই একধরনের রোমান্টিসিজম থাকে। বিপ্লবেরও পূর্ব শর্ত রোমান্টিসিজম। প্রচলিত ধ্যান-ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে সমাজ বদলে দেওয়া বা নতুন কিছু করে দেখানো, কোনও কিছুর মধ্যে নতুনত্ব বা এক্সাইটমেন্ট খোঁজা- এসবও তারুণ্যকে সশস্ত্র হতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে।
৯. কথা বলতে না পারা: কথা বলতে না পারার স্বাধীনতাও মানুষকে ক্ষুব্ধ করতে পারে এবং তার পরিণতিতে কেউ কেউ জঙ্গিবাদের মতো বিধ্বংসী পথে পা বাড়াতে পারে। অন্যের চাপিয়ে দেওয়া মত বা বিশ্বাসে ক্ষুব্ধ হয়েও কেউ কেউ জঙ্গি হতে পারে। এটা বলা যাবে না, ওটা বলা যাবে না- এটা বললে এটা হবে, ওটা বললে ওটা হবে- মানুষ যখন সব সময় এরকম একটা জুজুর মধ্যে থাকে, তখন ধীরে ধীরে তার ভেতরে ক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে এবং কেউ কেউ তখন সঙ্গ বা সুযোগ পেলে প্রতিশোধপরায়ণ হতে উঠতে পারে- যা আখেরে তাকে জঙ্গিবাদের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
সুতরাং জঙ্গি নির্মূলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান যেমন জরুরি, তেমনি জঙ্গিবাদ তৈরি হবে না- কেউ জঙ্গি হবে না- এমন পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে তোলা আরও বেশি জরুরি।
সুত্র: বাংলা ট্রিবিউন